প্রবীর বিকাশ সরকার : আমার জীবনে দেশ-বিদেশে যে ক’জন বিরল মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সম্পর্ক বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে বদলি হওয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

তিনি রাজধানী ঢাকার জেলা প্রশাসক হয়ে চলে গেছেন। কী পরিতাপের বিষয় তাঁর বিদায়বরণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারলাম না!

তাঁর নেইম কার্ডটি আমার সামনে এখন। দেখছি আর এক ধরনের বিচ্ছেদ-বিষণ্নতা অনুভব করছি। এই কারণে যে, তাঁর সঙ্গে কুমিল্লায় ফিরে গেলে আর দেখা হবে না। বিনম্র নরম কণ্ঠে বলবেন না হাত বাড়িয়ে, ‘প্রবীরবাবু কেমন আছেন।’ আমিও হাত বাড়িয়ে বলতে পারব না, ‘স্যার ভালো আছি।’

ঢাকায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারব বলে মনে হয় না। কারণ যে ব্যস্ততার চাকরি তাঁর সময় করে ওঠা কঠিন হয়ে যাবে। তবুও দেখা হবে এই প্রত্যাশা বুকে জেগে থাকবেই।

আসলে কথায় বলে স্বর্ণকারই সোনা চেনে। তোফাজ্জল স্যারকে দেখেই আমার প্রথম মনে হয়েছিল তিনি সাধারণ একজন সরকারি আমলা নন, সাধারণ এলিটও নন। অত্যন্ত উচ্চমার্গের মানুষ তিনি। বিদ্বান তো বটেই। পটুয়াখালির অভিজাত মিয়া বাড়ির সন্তান হিসেবে বড়মাপের চারিত্রিক গুণাগুণ তাঁর মধ্যে উজ্জ্বল। তাঁর মধ্যে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে বোঝার মতো অনন্য একটি সদিচ্ছা আছে একইসঙ্গে গুণীকে তার গুণের জন্য মূল্য প্রদানের মানসিকতা সদাজাগ্রত। যেটা এখন উভয় বাংলার বাঙালির মধ্যে বিরল বললেই চলে।

যেহেতু কুমিল্লা সদরে বড় হয়েছি এবং ডিসি অফিস চত্বরে অবস্থিত সদর পুলিশ কোর্টের জিআরও (জেনারেল রেকর্ড অফিসার) ছিল আমার বাবা, প্রথম জীবনের একটা সময় ডিসি অফিসেই কেটেছে আমার হেসেখেলে। ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক ডিসি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজনকে স্মরণে আছে একজন আমিনুর রহমান এবং অন্যজন আশিকুর রহমান। তাঁরা অনেক কাজ করে গেছেন কুমিল্লার জন্য। কিন্তু তোফাজ্জল স্যার ছিলেন অন্যরকম কারণ তিনি একজন সিরিয়াস গ্রন্থপাঠক এবং তিনি এত অল্পসময়ের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন যে কিছু করার আগেই বদলি হয়ে চলে গেলেন। না ঠিক তা নয়, বলা প্রয়োজন তাঁর প্রতিভা ও কর্মদক্ষতাই তাঁকে রাজধানীতে নিয়ে গেছে। এই জন্য তাঁকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। তবে যতদিন ছিলেন একটা নাড়া দিয়েছিলেন স্থানীয় প্রশাসনে। যেমন কাজের দিক দিয়ে তেমনি অমায়িক ব্যবহার এবং সাংস্কৃতিক চিন্তাচেতনার দিক দিয়ে। বিশেষ করে জমিদলিলের দপ্তরটিকে তিনি ডিজিলাইজড করে দিয়েছেন। থাকলে আরও কাজ করতেন তাতে কোনো ভুল নেই। কুমিল্লার মানুষের জন্য তাঁর মতো চৌকস ডিসিই প্রয়োজন। তবে তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন, স্বল্প সময়েই কুমিল্লার নাগরিকদের জটিল চরিত্র সম্পর্কে তাঁর গভীর ধারণা হয়ে গিয়েছিল। এর আগেও তিনি একবার কুমিল্লায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন কাজেই কুমিল্লার মানুষের ঐক্যহীনতা, আগ্রহহীনতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকারই কথা। বিনয় সাহিত্য সংসদের আলোচনাসভায় সেকথা তিনি প্রসঙ্গক্রমে প্রকাশও করেছিলেন।

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে গত বছরের এপ্রিল মাসে ‘সচেতন নাগরিক কমিটি’ তথা ‘সনাকে’র একটি অনুষ্ঠানে, কুমিল্লার খ্যাতিমান ক্রীড়াসংগঠক এবং আবিৃত্তকার বদরুল হুদা জেনুভাই এই সংগঠনের প্রধান। আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল এর সদস্য বিশিষ্ট সাংবাদিক, আলোকচিত্রী এবং প্রাচীন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আমোদ’ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাকীন রাব্বী। জিয়াকাকাও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানেই সন্ধেবেলা ডিসি তোফাজ্জল স্যার অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে চাচক্রে তাঁর সঙ্গে কথা বিনিময় হয়। জাপানের কথা ওঠে, জিয়াকাকা আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন জাপান প্রবাসী লেখক, গবেষক বলে। তিনি তাই শুনে বলে ওঠেন, ‘আরে তাই নাকি! আমি তো জাপানে গিয়েছি ১৯৯৯ সালের দিকে সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজে।’ এবং কিছু জাপানি বাক্য বলে তিনি আমাকে অবাক করে দেন! আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তিনি সাধারণ মানুষ নন।

তারপর সরাসরি সাক্ষাৎ করতে যাই গত বছরের মে মাসের ২১ তারিখ। তারিখটি আমি তাঁর নেইম কার্ডের উল্টো পিঠে লিখে রেখেছিলাম। দুপুরের কাছাকাছি সময়, তাঁর কক্ষে প্রবেশ করতেই আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে ও জিয়াকাকা তথা ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদকে। কাকাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদেরকে চিনতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অধীনস্থকে চা দেবার জন্য অনুরোধ করলেন। নরম কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললেন, ‘অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত।’ আমরা বললাম,‘ না না। দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই। এত ব্যস্ততার মধ্যেও যে আপনি সময় দিয়েছেন আমাদেরকে তার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।’

উত্তরে তিনি বললেন, ‘সরকারি চাকরি। প্রচুর কাজ। তার মধ্যেও সময় বের করে পড়ি, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাই।’ এরপর আমরা নেইমকার্ড বিনিময় করলাম। আমি শিশু পত্রিকা ‘কিশোরচিত্র’ প্রকাশ করি জেনে অত্যন্ত খুশি হলেন। পত্রিকাটি খুলে দেখলেন। সেইসঙ্গে আমার কয়েকটি বই উপহার দিলে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলেন। বিদ্বান মানুষ বই পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। বই হয়ত সব মানুষকে নয়, কিন্তু কিছু মানুষকে এতই মানবিক ও মহান করে তুলে তাঁর প্রমাণ এর আগেও আমি পেয়েছি। এবারও পেলাম সেই বিরল মানুষদের একজন তোফাজ্জল স্যারকে। সাদামাটা পোশাকে অনুচ্চ কণ্ঠে যিনি মানুষের কথা শোনেন অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে। কথাও বলেন সুস্পষ্টভাবে এবং বাচনভঙ্গির মধ্যে আভিজাতিক শৈলী পুরোমাত্রায় লক্ষণীয়। কাজসম্পাদন তিনি দ্রুততার সঙ্গেই করেন তবে সেখানে তাড়াহুড়ো নেই বরং একটা নিয়মশৃঙ্খলার রেখা ধরে এগিয়ে যান সেটা আমি স্বচক্ষেই প্রত্যক্ষ করেছি।

তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্য ছিল আমার সদ্য স্থাপিত ‘মানচিত্র বইঘরে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি করা। নেইম কার্ড দেখেই বললেন, ‘জাপান থেকে একবারেই চলে এসেছেন নাকি। মাদাম এবং ছেলেমেয়ে?’ আমি বললাম, ‘না স্যার যাওয়া-আসার মধ্যে আছি। আমার স্ত্রী জাপানি। এক মেয়ে টিনা কেইও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমারও বয়স হচ্ছে। রাত পোহালে ৫৫ হবে। এবার দেশে কিছু করা প্রয়োজন। তাই শিশুদের জন্য একটি কাগজ প্রকাশ করছি। আর এই বইয়ের দোকানটি স্থাপন করেছি মূলত ছোটভাই চালাবে। আমিও সহযোগিতা করব।’ শুনে তিনি প্রীত হলেন এবং আমার কাজের প্রশংসা করলেন। ৪ঠা অক্টোবর ২০১৩ তারিখে উদ্বোধন করতে তিনি সম্মতি দিলেন।

তারপর চা পান করতে করতে না প্রসঙ্গে আলাপ হল। চলে আসার সময় বললেন, ‘আপনার বইগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। অবশ্যই পড়ব এবং আমার মতামত জানাবো। আপনি সময় পেলে সোজা আমার বাসায় চলে আসবেন ফোন করে যদি থাকি আলাপ-আলোচনা করা যাবে। জাপান এক বিস্ময়কর দেশ! আপনার কাছ থেকে সেদেশের গল্প শোনা যাবে।’ আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

৪ঠা অক্টোবর সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি। শীতকালে এমন বৃষ্টি খুব কমই দেখেছি বাংলাদেশে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। দারুণ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। তা হল না। কিন্তু এই ঝড়জলবৃষ্টির মধ্যেই যথাসময়ে ডিসি সাহেব চলে এলেন হাউজিংএ আমাদের বাসায়। যার দোতলায় আমি বইয়ের দোকান স্থাপন করেছি। শহর থেকে প্রায় ৩০ জনের মতো কবি, লেখক, সাংবাদিকসহ বন্ধুরা এসেছেন। বাবার বন্ধু এই শহরের স্বনামধন্য প্রবীণ ব্যক্তিত্ব রাজনীতিবিদ এডভোকেট আহমেদ আলী তথা চাচা এসেছেন। জিয়াকাকা এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন কবি ও বেতারব্যক্তিত্ব আইউব সৈয়দ এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক শফিকুর রহমান তথা শফিককাকা। ফলে আমার মনটা ভরে গেল নতুন এক আলোয়। মনেপ্রাণে সঞ্জীবিত হয়ে উঠলাম। দারুণ অনুপ্রেরণা পেলাম একসঙ্গে অনেক বছর পরে পুরনো বন্ধুদের পেয়ে। ডিসি স্যার ফিতে কেটে অনাড়াম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পাদন করলেন। ঘুরে ঘুরে দেখলেন। বই খুলে মন্তব্য করলেন। শুধু তাই নয়, নিজে বই কিনে তাঁর সঙ্গী প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেকে উপহার দিলেন। বললেন, ‘খুব দামি আর চমৎকার সব বই এনেছেন প্রবীরবাবু। আমি সত্যিই আনন্দিত। অভিনন্দন জানাচ্ছি।’ একটি আলোচনার আয়োজন করেছিলাম। তিনি চমৎকার বক্তব্য রাখলেন। জাপানের অনেক বিষয়ে আলোচনা করলেন যা আমিও জানি না। চমৎকৃত হলাম। তিনি যে বিস্তর পড়েন তার প্রমাণ পেলাম। আমিও বক্তব্য রাখলাম। ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা বললাম। ধীরে ধীরে এটাকে একটি ‘সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ করে তুলতে চাই বললাম। আহেমদ আলী চাচা, কবি ফখরুল হুদা হেলাল, কবি গাজী মোহাম্মদ ইউনুস, কবি ডা. ইকবাল আনোয়ার, কবি আইউব সৈয়দ, শফিকুর রহমান, নাট্যকার শাহ্জাহান চৌধুরী, কবি ও গল্পকার মোহাম্মদ আলমগীর, অধ্যাপক গৌরাঙ্গচন্দ্র দাস প্রমুখ কথা বললেন। শেষে চাচক্রের পর তোফাজ্জল স্যার নিচে নেমে এলে তাঁকে অন্দরে আহবান জানাই। তিনি সাগ্রহে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং মার সঙ্গে কথা বলেন। বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত নিঃসন্দেহে।

এরপর মাঝেমাঝে তিনি আমাকে ফোন দিতেন এবং মেইল করতেন। এমনটি আমার কাছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এককথায় আশাতীত। আমি অভিভূত! তিনি আমার বইয়ের প্রশংসা করেছেন ফোন করে এই ঘটনা কোনোদিন ভোলার নয়। মূল্যবান পরামর্শও দিয়েছেন। কখন যেন একটা অদৃশ্য আত্মিক নিবিড় বন্ধনে আমরা জড়িয়ে গেলাম।

খুব বেশি না হলেও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তার মধ্যে বিনয় সাহিত্য সংসদের ‘আপন’ সংকলনের প্রকাশনা অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাথ স্মরণে একটি অনুষ্ঠান এবং আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী সংগঠন আয়োজিত ‘মীর মোশাররফ হোসেন: জীবন ও সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা’ অনুষ্ঠানের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর যে এত অগাধ ধারণা ও পান্ডিত্য আমাকে যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছে। শুধু আমি বলেই নয়, যাঁরা সেসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বীকার করবেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তাই স্বদেশী সাহিত্য শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে মীর মোশাররফ হোসেনের ওপর তাঁর দীর্ঘ তথ্যবহুল আলোচনা শোনার পর।

একদিন ফোন করে অভিযোগ করলেন, ‘কী ব্যাপার অনুষ্ঠানগুলোতে আপনাকে দেখি না কেন?’ আমি বললাম, ‘স্যার একটু ব্যস্ততা বেড়েছে আর কিছুটা বেছে বেছে চলি।’ শুনে তিনি হাসলেন। বললেন, ‘জাপানে যাচ্ছেন কবে? যাবার আগে জানাবেন কিন্তু।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই স্যার। জানিয়েই যাবো।’

এরমধ্যে একদিন তাঁর বাংলাতো গেয়েছিলাম সন্ধেবেলা। জীবনে এই প্রথম ডিসি বাংলাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। বৃটিশ আমলে নির্মিত চমৎকার একটি স্থাপত্য বিশাল বাগানসহ দেখেই ভালো লেগে গেল। ঘণ্টা খানেক ছিলাম। নানা বিষয়ে আলাপ হল। কুমিল্লা শহরের পরিবেশ নিয়ে কথা বললাম। যানজট কীভাবে সমাধান করা যায় আলোচনা করলাম। তিনি একটি কথা বলেছেন যেটা আমার খুব ভালো লাগল, তিনি বলছিলেন, ‘দেখুন, আমরা প্রশাসনে থেকে অবশ্যই জেলার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা কিন্তু বসে নেই। ছুটির দিনেও আমি প্রশাসনিক কর্মকর্তা তথা ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে বাসায় মিটিং করি। কাজ এগিয়ে রাখি। জেলা বলেন, গ্রাম বলেন, শহর বলেন পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন নিয়ে প্রকল্প তৈরি করি, বাস্তবায়নের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে চলেছি। কিন্তু তারপরেও একটি কথা থেকে যায়। সেটা হল, শহরটা আপনাদের। প্রশাসন তো কাজ করছে করবেই এটা দায়িত্ব-কর্তব্য কিন্তু সবচে বড় দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে আপনাদের। যারা শহরে বসবাস করছেন। আপনাদের বাসস্থানের চারপাশ, বাজার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল তথা শহরকে কীভাবে সুন্দর রাখবেন, সুষ্ঠু পরিবেশে সাজিয়ে রাখবেন এই নাগরিক দায়িত্ব আপনাদেরই। সমস্যা আছে, থাকবে কিন্তু সেটা সমাধানের বিষয়ে আপনাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে। জাপানে আপনি দীর্ঘদিন ধরে আছেন, সেখানেও কী তাই হচ্ছে না?’ স্যার একদম সত্যি কথা বলেছেন। বাঙালির কোনো জ্ঞানবুদ্ধি নেই পরিবেশ সম্পর্কে এটা মানতেই হবে। স্কুল কলেজেও বাস্তব কোনো শিক্ষা দেয়া হয় না জাপানে যেমনটি দেখেছি। একুশ শতকে একি ছিরি হয়েছে একদা পরিকল্পিত শহরটির ভাবলে আশ্চর্য না পারি না। কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ দোষ দিয়ে থাকি প্রশাসনকে। অবশ্য সিটি কর্পোরেশনেরও কঠোর হওয়া উচিত। যাহোক, আলোচনার পর দেশি ফলফসারি খেলাম আমরা। বিদায় নিলাম।

এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের এক শুক্রবার সকালে আমরা অর্থাৎ আমি, জিয়াকাকা ও তাঁর মেয়ে প্রমি গেলাম ডিসি বাংলাতে। তিনি তাঁর অফিসকক্ষে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিলেন। প্রমি ‘কিশোরচিত্র’ পত্রিকার জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করল। খুব চমৎকারভাবে তিনি উত্তর দিলেন প্রমির প্রশ্নগুলোর। চা-মিষ্টি খেয়ে বিদায় নিলাম। পত্রিকা প্রকাশিত হলে তাঁকে সৌজন্য কপি দিতে গেলাম কিন্তু দেখা হল না। তিনি মালয়েশিয়া গেছেন পিএস জানালেন। তবুও সৌজন্য কপি অফিসে রেখে এলাম।

এরপর স্যারের সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়েছিল টাউন হল প্রাঙ্গণে বিকেলবেলা একদিন। সেদিন গিনেসবুকে তুলে ধরার জন্য লক্ষকণ্ঠে জাতীয়সঙ্গীত গাওয়ার অনুষ্ঠান ছিল। তিনি খুব সাধারণ পোশাকে এসেছিলেন। আমি তাঁকে সালাম জানালাম। তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেই বিনম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রবীরবাবু কেমন আছেন।’

এইই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার আপাত শেষ দেখা। এর মধ্যে আমিও জাপানে চলে আসব ব্যস্ততা ছিল। ঢাকায় চলে গেলাম। বেশ কয়েক দিন ছিলাম। এর মধ্যে একদিন জিয়াকাকা, মা এবং বন্ধু চন্দন ফোন করে বললেন, ‘আরে তোমাকে ডিসি সাহেব খুঁজে খুঁজে হয়রান। তোমাকে ফোন করে পাচ্ছেন না। আমাদেরকে ফোন করেছেন। তুমি তাড়াতাড়ি ফোন দাও তাঁকে।’

আমি একটু অবাকই হয়ে গেলাম! স্যার এভাবে খুঁজছেন কেন আমাকে? কোথাও ভুল করলাম কিছু, কই মনে তো পড়ে না। এভাবে তো আমার মতো সাধারণ নাগরিককে একজন জেলা প্রশাসক খোঁজার কথা নয়! আমি ভেবে দেখলাম, স্যার আমাকে ফোনে না পাওয়ার কারণ, আমি তো ফোন বদল করেছি নতুন নম্বর তাঁকে ভুলে জানানো হয়নি। সাংঘাতিক অপরাধ করে ফেলেছি! সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ফোন দিলাম। তিনি বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘আরে আপনি কোথায় ছিলেন? ভাবলাম জাপানে চলে গেলেন কিনা। আপনাকে খুঁজে ছিলাম রামমালা গ্রন্থাগারটিকে আমরা ডিজিটাল সিস্টেমে আনবো এই জন্য আপনার প্রস্তাব, পরামর্শ জানতে চেয়েছিলাম।’ আমি ফোনের ব্যাপারটি খুলে বলে বার বার ক্ষমা চাইলাম। তিনি শান্ত হলেন। তখন আমি বললাম, ‘স্যার, আমি এখন ঢাকায়। এপ্রিলের ১৬ তারিখ জাপানে যাচ্ছি।’ শুনে বললেন, ‘তাই নাকি? আহা, যাওয়ার আগে দেখা হল না। ঠিক আছে সাবধানে যাবেন। আর আমার শুভেচ্ছা মাদাম ও কন্যাকে পৌঁছে দেবেন। ফিরে এলে দেখা হবে।’ আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম এবং বললাম, ‘স্যার আপনিও সাবধানে থাকবেন, আপনার পরিবারের সকলের প্রতি থাকল আমার শুভেচ্ছা ও সালাম। সায়োনারা।’ স্যারও একটু থেমে বিষণ্ন কণ্ঠে উত্তর দিলেন ‘সায়োনারা।’

জীবনে চলার পথে এভাবে অকস্মাৎ এমন কিছু মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছে যাঁদের অধিকাংশই এই ধরায় নেই, কিন্তু তাঁদেরকে সবসময় অনুভব করি। কিছুতেই জীবনের খাতা থেকে তাঁদের নাম মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তোফাজ্জল স্যার তাঁদের অন্যতম। তিনিও নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে যাবেন না। ‘আবার দেখা হবে’ এই আশায় আমার বুকের ভেতরে এক মহাআনন্দ ক্রমশ স্ফীত হতে থাকবে। ঈশ্বর তাঁকে তাঁর গুরুদায়িত্ব পালন, দেশসেবা এবং মনোবাঞ্ছা পূরণ করার শক্তিদান করুন এই প্রার্থনা করি। আমার একান্তই বিশ্বাস তাঁর মতো যদি দশ জনও রাষ্ট্রীয় জনসেবক দেশে থাকে সে দেশ জাপানের উন্নয়নকেও ছাড়িয়ে যাবে একদিন। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়।

লেখক: জাপান প্রবাসী

(এটিআর/জুলাই ০৭, ২০১৪)