বিশ্বজিত বসু


তখন যদি ৩৫ এর যুগ না হতো, এরকম ফোন ব্যবহার করে ছবি তোলা যেত তাহলে হয়তো তাঁর সাথে আমার একাধিক ছবি তুলে রাখতে পারতাম। সেই ছবিগুলো হতো সম্পদ। পরবর্তী প্রজন্ম সেই ছবিগুলো দেখে গর্ব অনুভব করতো। তবে সে গর্বটা অনুভব করতো আমার জন্য নয়, যার সংগে আমার ছবি তাঁর জন্য।

হ্যাঁ আমি জাফর ইকবালের কথা বলছি। ড. জাফর ইকবালের কথা বলছি, অধ্যাপক জাফর ইকবালের কথা বলছি। একজন সু সাহিত্যিকের কথা বলছি, একজন আলোর পথের দিশারির কথা বলছি।

১৯৯৯ সালে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ঢাকার একটি সফ্টওয়ার কোম্পানীর ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষে। সংগে ছিলেন প্রৌকশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কায়কোবাদ।

এরপর তাঁকে খুব কাছের থেকে দেখেছিলাম ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াস ইনিস্টিটিউটের মিলনায়তনে একটি সেমিনারে। সেমিনারের আয়োজক ছিল নাগরিক সমাজ। নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক তখন ড. কামাল হোসেন। তখন আমি নাগরিক সমাজের একজন কনিষ্ঠ কর্মী। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

তিনি প্রায় দুইশত বই লিখেছেন। তাঁর লেখা গল্প থেকে উপন্যাস দীপু নাম্বার টু দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম তার ক্ষমতা। তখন থেকেই আমি তাঁর ভক্ত। তাঁর লেখা বই কেনার আর্থিক সামর্থ্য তঋন আমার ছিল না। বই সংগ্রহ করতাম পল্টন মোড়ের পুরানো দোকান থেকে কম পয়সায়। সেখানে ড. জাফর ইকবালের লেখা বই পেতাম না। তাঁর লেখা বিজ্ঞানের একশত মজার খেলা বইটির সিডি বের করে ডাটা সফট সিস্টেমস্ লিমিটেড। সেটা আমাকে উপহার দিয়েছিল ডাটা সফট এর মালিক মাহবুব জামান। এরপর সময়ের সাথে সাথে পরিণত হয়েছি তাঁর ভাব শিষ্যে । অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর দেখেছি আমার বন্ধু রাশেদ সিনেমাটি।

নিজগুুণে তিনি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের আলোর দিশারি পরিণত হয়েছেন। তিনি শ্রেণী কক্ষে ছাত্রদের পড়ান, দেশে তথ্য প্রযুক্তি কিভাবে বিশ্বের সমান তালে এগিয়ে যেতে পারে তার জন্য উপদেষ্টার কাজ করেন, বই লেখেন, তার বইয়ের ঘটনা নিয়ে নাটক সিনেমা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রাস্তায় নেমে পড়েন। বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড সূচনা করে শিশু কিশোরদের গণিতকে কাব্যরুপে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুল্ ধরেন। এরকম হাজারো ছোট বড় উদ্যোগেের ফলস্বরূপ তিনি নিজেই নিজের ব্রান্ড। এবং যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কাজ করেন সেই শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আর তিনি সমার্থক। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করলে সামনে ভেসে উঠে ড.জাফর ইককবালের নাম। যুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক সমাজ গঠনে জাফর ইকাবল নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নেতৃত্বের আসনে। সেটা প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে।

সেই সাথে শত্রুও হয়েছেন এক শ্রেণীর। শত্রু হওয়ার পিছনে কারণ বিজ্ঞান মনস্কতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা। এ দুটোকেই বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি তাদের বাঁধা মনে করে। সেজন্য তিনি মোলবাদী শক্তির টার্গেট। তারা সেই বাধাকে সরিয়ে দিতে চায়।

ড. জাফর ইকবালকে হত্যা করতে হলে প্রথমে তাঁর জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামানো প্রথম কাজ। সেজন্য তাকে নাস্তিক তকমা লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে । জাফর ইকবাল ২০০ বই লিখেছেন। তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হক চ্যালেন্জ করে বলেছেন কোন বইয়ের কোথাও ধর্ম বা ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে একটি শব্দও ব্যবহার করেন নাই। তার পরেও অনেকে এই প্রচারে বিশ্বাস করে। ফেসবুকে নানাজনের বিভিন্ন লেখায় মন্তব্য দেখলেই সেটা স্পষ্ট। এ সমস্ত মন্তব্য দাতাদের মধ্যে আছে অনেক বিশ্ববদ্যালয় পাশ করা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এমনকি বিদেশে এসে নামের আগে ডক্টরেট বসিয়েছে সে সংখ্যায়ও অনেক।

মন্তব্যগুলো দেখে এটা স্পষ্ট যে তারা চরম মৌলবাদী চেতনা লালন করেন। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছেন শুধুমাত্র ভাল চাকুরি করা আর অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে। চেতনাকে শানিত করার জন্য নয়। এরা সভ্যতা বিকাশের ধারাটা জানে না বা জানলেও মেনে নিতে কষ্ট পায়।

যুক্তি ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নায়কেরা সব সময়ই নিগ্রহের শিকার হয়েছেন প্রতি পদক্ষেপে। নিগ্রহকারীরা কখনও কোন রাষ্ট্র প্রধান, কখনও ধর্মবেত্তা। সময়ের সাথে সাথে নিগ্রহের ধরণ পাল্টেছে। আগে ছিল গিলেটিনে হত্যা, বিষ পান, আমৃত্যু কারাবাস। এখন চাপাতি অথবা গুলি।

ড. জাফর ইকবাল কিম্বা অভিজিতকে আক্রমণ এবং হত্যার মধ্যে যথার্থতা খুজে পান তাদের কাছে এই লেখার কোন মুল্য নাই। তবুও পুরানো ইতিহাস তুলে ধরে তাদের একজনকেও ভুল ভাঙানো সেটা অনেক বেশী পাওনা। সেই সাথে তাদের এটুকু স্মরণ করিয়ে দেয়া ইতিহাসে নিগ্রহকারীর অবস্থান ঘৃণার সারিতে। যারা সমর্থন করেন তাদেরও।

সতিদাহ প্রথা বিলোপ সাধনে রাজা রাম মোহন রায় অনেক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। নিগ্রকারীরা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। জাগরণের নায়ক স্যার সৈয়দ আহম্মেদকেও মৃত্যুমুখ থেকে উদ্ধার করেছিলেন হায়দারাবাদের নিজাম। আপনারা যারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা প্রযুক্তি বিদ্যায় শিক্ষিত হয়েও জাফর ইকবালদের হত্যা করাকে জায়েজ মনে করেন আপনারা কিন্তু স্যার সৈয়দ আহম্মেদ জাগরণী আন্দোলনের ফসল। না হলে আপনার অবস্থান থাকত গাবের হাজারে। সৈয়দ আহম্মেদ বা জাফর ইকবালদের জন্য আপনার আজ এখানে।

খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ শতাব্দীতে এনাক্সিমেন্ডর এবং পিথাগোরাস বলেন পৃথীবি ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চার পাশে পরিভ্রমণ করছে। এই মত প্রচারের জন্য তাঁদের নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছিল। নিগ্রহকারীরা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। পিথাগোরাস বেঁচে আছে পৃথীবির বুকে, মানুষের হৃদয়ে।

সঠিক প্রকৃতির নিয়ম আবিস্কার করতে গিয়ে গ্যালিলিওকে চরম চার্চিয় নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে। কারান্তরীণ থাকতে হয়ছে বৃদ্ধ বয়সে। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সমাহিত হয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে। মৃত্যুর একশত বছর পর সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ভাস্কর্য। গ্যালিলিও আজ সারা পৃথীবির মানুষের হৃদয়ে।

কাজী নজরুল ইসলাম যখন সাম্যের কথা বলেছেন তখন তাঁকে কাফের ঘোষণা করে নিজেরা মহা আত্মতুষ্টি পেয়েছে। সে সময়ে চাপাতি কালচার এত শক্তিশালী ছিল না বলেই হয়তো তিনি শারিরিক আক্রমণের শিকার হন নাই । তবে তিনি তাঁর আশংকার কথা বলে গেছেন। এখন সেই চেতনাধারীরা কাজী নজরুলকে সামনে এনে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার কাজে লিপ্ত। সেই সাথে ব্যস্ত তাঁকে খন্ডিত ভাবে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে। এই চেতনাধারীর আবার শামছুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবালদের মেরে ফেলতে চায়।

সক্রেটিস মৃত্যুমুখে বলেছিলেন "I to die, you to live, which is better god knows". সময়ের বিবর্তনে মানুষও জেনে গেছে "Which is better"। এখনকার সক্রেটিসরা বলে I to die, you to live , which is better god as wel as people know ।

যারা নজরুল বলতেন কাফির, ড. জাফর ইকবালকে কোপালে আনন্দে আত্মহারা হন, আপনাদের অবস্থান ইতিহাসের আস্তুকুড়ে। জাফর ইকবালেরা বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে ।

লেখক : প্রবাসী