চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি : ২৬ বছরের রূপার উচ্চতা ৩৪ ইঞ্চি, আর ১৭ বছরের মিমের ৩৩ ইঞ্চি। খর্বাকার সহোদর দু’বোনকে এলাকার লোকজন পুতুলকণ্যা বলেই চেনে। বয়সে যুবতী হলেও এদের চলাফেরা, আচার-আচরণ সবকিছু শিশুদের মতো। খেলাধুলা করে প্রতিবেশী শিশুদের সাথে। রাতে ঘুমায় মায়ের গলা ধরে। মাঝে মাঝেই দু’বোনকে দেখতে আসে দূর-দূরান্তের মানুষ। এলাকাবাসী মনে করেন, স্বল্প উচ্চতা ও ওজনের জন্য এরা খর্বাকার সহোদর বোন হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডে স্থান পেতে পারেন।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার আঠারখাদা গ্রামের রূপা আর মিম কথা বলে যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো করে। বয়স বেড়ে গেলেও এখনো তারা পুতুলকন্যা হিসেবে পরিচিত। পুতুলকন্যা দুই বোনের কারণে তাদের বাড়িটিও এলাকায় পুতুলবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সরেজমিনে আঠারোখাদা গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, কৃষক আব্দুর রশিদের তিন ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ে এক ছেলে। তাদের মা ফাতেমা খাতুন গৃহীনি। বড় মেয়ে রূপা (২৬), ছেলে নূর আলম জিকু (২১) ও ছোটো মেয়ে মিম (১৭)। নূর আলম জিকুর উচ্চতা স্বাভাবিক হলেও রূপা ও মিম খাটো। একেবারেই খেলনা পুতুলের মতো ছোটো। নূর আলম জিকু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষবর্ষের ছাত্র।

নূর আলম জিকুর লেখাপড়া অব্যাহত থাকলেও শুধু অস্বাভাবিক শারীরিক গড়নের কারণেই দুবোন রূপা ও মিমের লেখাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডিতেই থেমে গেছে। কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, ছোটোবেলায় রূপাকে স্কুলে ভর্তি করা হলে তার সহপাঠিরা রূপার শারীরিক গঠনের কারনেই রূপাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। মিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। ফলে, তাদের লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

ছোটোবেলায় যখন বোঝা যায় রূপা স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে না, তার চিকিৎসা করানো হয়। কোনো লাভ হয়নি। মিমের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মিমকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠেনি।

রূপা ও মিমের বাবা আব্দুর রশিদ আরো জানান, ওদের অস্বাভাবিক আকৃতির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর একযুগ আগে থেকেই মানুষ তাদের দেখতে আসে। আশা ছিল সরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য কিছু নিশ্চয় হবে। তেমন কিছু হয়নি। তিনি বলেন, ‘রূপার উচ্চতা ৩৪ ইঞ্চি, আর মিমের ৩৩। আমি মনে করি আমার মেয়েদের মতো এত কম উচ্চতার সহোদর বোন পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।’ তাই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে রূপা ও মিমের নাম দেখতে চান তিনি। এ জন্য জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন আবদুর রশিদ।

রূপা ও মিমের মা ফাতেমা খাতুন জানান, ‘জন্মের সময় ওরা খুবই ছোট আকৃতির হয়েছিল। বেঁচে থাকবে এ বিশ্বাস কারোরই ছিল না। ছোট মেয়ে মিমের জন্মের পর নিজের দেশসহ ভারতের অনেক নামী-দামি ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার ব্যাপারে সবাই নিরাশ করেছেন।’

রূপা খুব অভিমানী। খুব রাগি। বায়নাও ধরে খুব। দিনভর খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকে। আর মোবাইলে শিল্পী মমতাজের গান শোনে। গানের তালে তালে নাচে। ছোট মিমের রাগ-অভিমান অনেক কম। বাড়িতে এই আছে, এই নেই। খেলতে চলে যায় পাড়ায়। অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করে সে আনন্দ পায়।

গ্রামের সেলিম হোসেন জানান, এই দুবোনের বয়স যখন অনেক কম তখন থেকেই তারা তোতাপাখির মতো ছোটো ছোটো করে কথা বলে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাদের দেখতে আসে। অনেক মানুষ দেখলে দুবোনই লজ্জা পায়। বড়টা মিটিমিটি হাসে। কথা বললে বোঝে। কেউ কিছু খেতে দিলে লাজুকভাবেই তারা তা হাতে নেয়। আচরণ শিশুসুলভ। স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি আছে। তাদের বয়স বাড়লেও এখনো তারা ছোট্ট মেয়ের মতো বাবার কাধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়।

প্রতিবেশী সেলিম আরো জানান, ‘আমরা মনে করি রূপা ও মিম বিশ্বের সবচেয়ে ছোট নারী। পত্রপত্রিকার খবর পড়ে যদ্দুর জানি এদের মতো খাটো নারী বিশ্বে আর নেই।’

বাড়াদী ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য গিয়াসউদ্দিন জানান, সরকারিভাবে ওই দুবোনকে নিয়ে ভাবা দরকার। এখন তাদের বাবা মা রয়েছে। তাদের অবর্তমানে কে দেখবে তাদের? তাদের জন্য সরকারি উদ্যোগে স্থায়ী এমন কিছু করা দরকার যাতে তারা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারে। বাড়াদী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তোবারক হোসেন জানান, রূপা প্রতিবন্ধীভাতা পাচ্ছে। মিমও যাতে পায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহম্মেদ জানান, রূপা ও মিমের চেয়ে উচ্চতায় ছোট নেপালে ও ভারতে আছে বলে রেকর্ড আছে। তবে, দুই বোন খর্বাকৃতিতে রূপা ও মিম বোধহয় হবে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট। এ বিষয়ে আমরা দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানো হয়েছে। আমি যদোটুকু জানি রূপা প্রতিবন্ধীভাতা পেয়েছে। আগামিতে মিমকেও প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হবে।

(টিটি/এসপি/মার্চ ১৮, ২০১৮)