স্টাফ রিপোর্টার : আজ ২৫শে মার্চ। ভয়াল কাল রাত এবং জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকায় ঘটেছিলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ড।

সেই বছরের এই রাতে বর্বর পাক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর এদিন বাঙ্গালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের এক নৃশংস বর্বরতা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক বর্বরোচিত হামলার সেই বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে পালিত হবে জাতীয় গণহত্যা দিবস। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘটানো গণহত্যার দিনটি জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গত বছর।

স্বাধীনতার প্রায় ৪৬ বছর পর গত বছরের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্ব সম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব পাস হয়।

কী ঘটেছিল সেদিন:

২৫ মার্চের সেই দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। তখনো কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালির জীবনে। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়েও পড়েছে। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাকবোঝাই করে নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানের সৈন্যরা ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো শহরজুড়ে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার।

মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের মাধ্যমে পাক জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। হকচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। মানুষের কান্না ও আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে শহরের আকাশ। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হলো লাশের শহরে। ঢাকা শহরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে তারা বাঙালি নিধন শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে। আর এর মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক।

শুধু নিষ্ঠুর ও বীভংস হত্যাকান্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। পাক হানাদাররা সেই রাতে অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েক জন গণমাধ্যম কর্মীকেও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তাদের কাল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

২৫ মার্চ রাত সোয়া ১টার দিকে এক দল সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। এ সময় বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাতের জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল।

অবশ্য গ্রেফতার হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তত্কালীন ইপিয়ারের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। আর এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছে। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙ্গর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তত্কালীন শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল, রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা।

জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে সেই কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার বীর বাঙালিদের। রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

কর্মসূচি

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহীদবেদিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করবে জগন্নাথ হল পরিবার। এর আগে রাত ১১টায় হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মশাল মিছিল হবে।

বিকাল তিনটায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র্রে আলোচনা সভা আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অন্য আয়োজনের মধ্যে রয়েছে আজ সন্ধ্যা সাতটায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ দেশ-বিদেশের শহীদ মিনারে আলোর মিছিল ও গ্রামীণফোনের উদ্যোগে রাত সাড়ে ১০টায় মানিক মিয়া এভিনিউতে আলোর যাত্রা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ সংলগ্ন স্থানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ: গণহত্যা ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে সকাল আটটা থেকে একই স্থানে গণহত্যার ওপর আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী শুরু হবে।

পাশাপাশি একই দিন সুবিধাজনক সময়ে সারাদেশে মসজিদ, মন্দিরসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে ২৫ মার্চ নিহতের স্মরণে প্রার্থনা করা হবে। সন্ধ্যা ছয়টায় রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হবে।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১-এর উদ্যোগে আজ রাত ১১টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘স্বাধীনতা চত্বরে’ দেশাত্মবোধক গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। এটি চলবে রাত সোয়া ১২টা পর্যন্ত। এর আগে বিকাল পাঁচটা থেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনী হবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে বেলা ১১টায় সংগঠনের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘২৫ মার্চের গণহত্যা’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।

গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমির উদ্যোগে রাজধানীর উত্তরা রবীন্দ্র-নজরুল মুক্তমঞ্চে আজ রাত ৯টায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ২৬ মার্চ সকাল ১০টা থেকে চিত্রাঙ্কন, বিকাল তিনটা থেকে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে আজ বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিকেল ৩টায় ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সিপিবি-বাসদের উদ্যোগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন পর্যন্ত ‘আলোর মিছিল’ অনুষ্ঠিত হবে। শ্রমিক-কর্মচারী পেশাজীবী মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে আজ বিকেল ৪টায় শাহবাগ চত্বরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা এবং গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসব অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করবেন।

(ওএস/এসপি/মার্চ ২৫, ২০১৮)