এমএ বশার, বাউফল (পটুয়াখালী) : রাত ৯টা ১ মিনিটে গনহত্যা দিবসে প্রতিকী আলোহীন হবে দেশ। আবার সকাল হলেই পুরো দেশের সঙ্গে আলো জ্বলমলে স্বাধীনতা দিবসের নানান কর্মসূচির মধ্যে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির শামসুর রহমানের লেখা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ এই কবিতা আবৃতিতে অংশ নেবে সে।

ক্লাস-টিচারের কাছে এসব শুনে ঘরে ফিরলেও চোখ-মুখ ফ্যাকাসে আলোহীন যেন তার। বাড়ির লোকজনের কানাকানিতে মুখে দানা-পানি কিছুই ওঠছিলনা দুপুরবেলা থেকে। পালানোর উপায়ও পাচ্ছিল না অন্ধকারে। বিয়ের শাড়িতে সাজতে হবে জেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে শুদ্ধসুরে সমস্বরে জাতীয় সংগিত কিংবা আবৃতির মতো সব সুখ যেন ভেঙে চুরমার। পালানোর মতো কোন উপায় না
পেয়ে চুপিসারে অন্যের মোবাইলফোন থেকে কল করে কেবল উদ্ধারের আকুতি তানিয়ার আক্তারের (১৪)।

জীবন-যৌবন কোন কিছু বুঝে না উঠলেও বাবা-মায়ের ইচ্ছেতে লাল শাড়িতে পিড়িতে উঠতে চাচ্ছিল না তানিয়া। বিয়ের আয়োজনে বাড়ির লোকজনের কোলাহল যখন আরো বিষিয়ে তুলছিল তাকে; ঠিক তখনই খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হন উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান। প্রতিকী আলোহীন সময়ে টর্চের আলোয় উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার উপস্থিতিতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে পটুয়াখালীর বাউফলের দ্বীপাশা দাখিল মাদ্রাসার ১০ম শ্রেণির ছার্ত্রী গোসিংগা গ্রামের তানিয়ার চোখে-মুখে। বিয়ের শাড়ি ফেলে বাল্য বিয়ে থেকে রক্ষা পেয়ে স্বাধীনতার সুখ খুঁজে পায় সে।

তানিয়ার ক্লাস টিচার পুলিন চন্দ্র রায় জানান, গোসিংগা গ্রামের রিক্সাচালক শহিদুল ইসলামের মেয়ে তানিয়া। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সাবার ছোট সে। গোপনে উৎকোচ নিয়ে পেশায় ড্রাইভার নাজিরপুর এলাকার এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করেন প্রতিবন্ধি বাবা শহিদুল ও মা হনুফা বেগম। গার্মেন্ট
কর্মি ও ড্রাইভার দু’ভাইয়ের সংসারে অসহোযোগিতা, অভাব-অনটন কিংবা মেয়ে বড় হলে পাড়ার ছেলেদের নজর পড়তে পারে ঠিক এমনটি ভেবে মেয়ের বিয়েতে রাজি হন তানিয়ার বাবা-মা। মেয়ের সম্মতি না নিয়েই জোর করে বিয়ের আয়োজনে ব্যাস্ত হচ্ছিলেন সবাই। এরই মধ্যে কয়েক আত্মীয়-স্বজনও এসে উপস্থিত। উপায় না পেয়ে কৌশলে অন্যের মোবাইলফোনে স্থানীয় এক সাংবাদিককে উদ্ধারের আকুতি জানায় তানিয়া।

এরপর সাংবাদিকের মাধ্যমে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে খবর পেয়ে স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনের যাবতীয় কর্মসূচির ব্যাস্তময় প্রস্তুতি ফেলে বিয়ের অনুষ্ঠানিকতার খানিক আগে রোববার রাত পৌনে ৯টায় স্থানীয় এক সাংবাদিক, অফিস কর্মচারী ও পুলিশ নিয়ে সেখানে ছুটে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। অন্ধকারে টর্চের আলোয় নির্বাহি কর্মকর্তার উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়ে বিয়ের কাজী সাহেবসহ বর পক্ষের লোকজন। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা টর্চের আলোয় খুঁজেবের করেন তানিয়া ও তার মাকে। চর্চের আলোয় বর পক্ষের সবাই পালিয়ে গেলেও উজ্জ্বল হয় তানিয়ার মুখ। প্রতিকী আলোহীন রাতে যেন স্বাধীনতা দিবসের পূর্বক্ষণে স্বাধীনতার সুখ খুঁজে পাচ্ছিল তানিয়া।

পরে স্থানীয় মেম্বর, মা হনুফা বেগম, গন্যমান্যসহ সবার সম্মতিতে মুচলেকা নিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা তানিয়ার পড়াশুনার খোঁজ-খবর রাখার দায়িত্ব দেন তানিয়ার মাদ্রাসা সুপার মাও. আব্দুর রহমানকে। পড়াশুনাসহ আর্থিক সহোযোগিতার আস্বাস দিয়ে তানিয়ার নোট খাতায় নিজের
অফিসিয়াল নম্বরও লিখে দিয়ে আসেন উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান।

মোবাইলফোনে তানিয়ার মাদ্রাসার সুপার মাও. আব্দুর রহমান বলেন, ‘সহ-সুপারসহ আমি ওদের ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। মাদ্রাসায় আজকের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে না এলেও আগামি দিন থেকে ক্লাসে ফিরবে তানিয়া। তানিয়ার মা হনুফা বেগমের সঙ্গেও কথা হয়েছে। রাস্তায় কাজ করেন ওই মহিলা। বাবা শহিদুল প্রতিবন্ধী। নানান প্রতিকুলতায় মেয়ের বাল্য বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন তারা।

তানিয়া সাময়িক মন খারাপ করলেও এখন হাসি-খুসি আছে। শ্রেণিতে রোল নম্বর ১৫ হলেও তানিয়া খুবই মেধাবি ছাত্রী। ওর পড়াশুনার দিকে আমরাও নজর রাখব। অল্প বয়সে বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভিষন খুশি সে।’

উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুহ জামান বলেন, ‘গণহত্যা দিবসের প্রতিকী আলোহীন সময় চলছিল। বাল্যবিয়ের বিষয়টি জেনে স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচির শত ব্যস্ততা আর অন্ধকার পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছি। তানিয়ার সম্মতি ছাড়া ওই বাল্য বিয়ে ভেঙে গিয়ে সেই আলোহীন অবস্থা ঠেলে যেন স্বাধীনতার নতুন আলো এসেছে তার জীবনে। তানিয়ার মতো বাল্যবিয়ে রোধে সকল শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়া দরকার।’

(এবি/এসপি/মার্চ ২৬, ২০১৮)