মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ারর্দী ময়দানের ভাষণের পর দেশব্যাপী মুক্তিকামী জনতা দেশকে স্বাধীনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। সেজন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মৌলভীবাজারে পাক হানাদার বাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রতিরোধ যুদ্ধে পৃথক পৃথক স্থানে তিন জন দেশপ্রেমিক নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করে । এই সংঘর্ষে সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গোজারাই গ্রামের লুন্দুর মিয়া, কনকপুর ইউনিয়নের কসবা গ্রামের তারা মিয়া ও কামালপুর ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের জমির মিয়াসহ তিনজন প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন । তাদের তিন জনের মধ্যে তারা মিয়া ও জমির মিয়াকে সদর উপজেলার শ্রীরাইনগর এলাকার মনু নদীর নিকটবর্তী স্থানে মাত্র পঞ্চাশ গজের ব্যবধানে পাকহানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে এবং লুন্দুর মিয়াকে চাঁদনীঘাট এলাকায় হত্যা করা হয়। একই দিনে গেরিলাযোদ্ধা মনে করে শহরের ফরেষ্ট অফিস এলাকায় দেশপ্রেমিক ৫-৭জন ইটভাটা শ্রমিককে ব্রাশ ফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা যায়, কনকপুর ইউনিয়নের কসবা গ্রামে নিজ বাড়ীর পাঁচশগজ দূরে মসজিদের পাশে রয়েছে হানাদারদের গুলিতে শহীদ হওয়া তারা মিয়ার কবর। সেখানে কবরে পাকা দেয়ালের নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে মৌলভীবাজারে প্রথম প্রহরে শহীদ মোঃ তারা মিয়া (২৭ মার্চ ১৯৭১)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাশেই রয়েছে শহীদ তারা মিয়া বাড়ি। সন্ধ্যার আলোহীন অন্ধকার পথ বেয়ে তারা মিয়ার বাড়ি পৌঁছেই দেখা হয় তার বড় ছেলে ফারুক মিয়ার সাথে। এসময় তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবার বয়স ছিল ৩৫ বছর আর তিনি তখন পঞ্চম শ্রেণীর স্কুল শিক্ষার্থী ।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফারুক মিয়া বলেন, বাবার সাথে সেদিন মিছিলে আমিও ছিলাম, আমার বাবা ও রাধানগরের জমির মিয়া খুব সাহসী উল্লেক করে তিনি বলেন, সেদিন মিছিলটি শ্রীরাইনগর পৌঁছতেই পাক বাহিনী একটি জিপে করে মিছিলে সামনে এসে গাড়িটি থামালে সবাই এদিক সেদিক আতœরক্ষার জন্য দৌঁড়াতে থাকলেও তারা মিয়া ও জমির মিয়া সাহসিকতার সাথে ছুলফি হাতে পাক সৈন্যদের দিকে ছুড়ে মারতে চাইলে হানাদার সৈন্যরা তাদের দুজনকেই গুলি করে হত্যা করে।

তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে একই দিনে এই তিন দেশপ্রেমিক হানাদারদের গুলিতে শহীদ হয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকলেও তাদের তিন জনের মধ্যে একমাত্র তারা মিয়ার নাম রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় । আর জমির মিয়া ও লুন্দুর মিয়া নামের দুই শহীদের নাম আজও স্থান হয়নি সেখানে।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামাল উদ্দিন (৬৩) এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, একই দিনে দু’দিক থেকে মিছিল অর্থাৎ শ্রীরাইনগর ও চাঁদনীঘাট ব্রীজে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দুটি মিছিল এলে সেখানেই লুন্দুর মিয়াকে তার বাড়ির পাশে পাক সৈন্যরা গুলি করে এবং শ্রীরাইনগরে মিছিলে থাকা জমির মিয়া ও তারা মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তিনি বলেন, প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে জমির মিয়াকে শহীদ করে হানাদার পাক বাহিনী। তবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তারা মিয়ার নাম থাকলেও নেই লুন্দুর মিয়া ও জমির মিয়ার নাম ।

এ বিষয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ হওয়ার পরেও এই দুই বীর শহীদের নাম নেই এটা ঠিক, আমরা মনে করি এরাই মৌলভীবাজারের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ, তবে তাদের মধ্যে তারা মিয়ার নাম তালিকায় আছে। তিনি স্বীকার করেন লুন্দুর মিয়া ও জমির মিয়ার নাম তালিকায় না থাকা দুঃখজনক, আমরা যাচাই বাচাই করে এই দুই শহীদের নাম পাঠাবো।

এদিকে জমির মিয়ার নাম মুক্তিযুদ্ধ তালিকায় না থাকা প্রসঙ্গে শহীদ তারা মিয়ার ছেলে ফারুক মিয়া বলেন, জমির মিয়া যখন শহীদ হন তখন তার বয়স ছিল ১২-১৩ বছর, তার আতœীয় স্বজন কেউ সম্ভবত বেঁেচ নেই , তালিকায় নাম নিয়ে হয়তো কেউ যথাযথ ভাবে যোগযোগ করেননি, সে কারণেই তার নাম তালিকায় হয়তো নেই। তিনি আরো বলেন, আমার বাবা ও জমির মিয়া পাশাপাশি একই সময়ে শহীদ হয়েছেন ।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে সদর উপজেলার কামালপুরের বাসিন্দা ও বর্তমানে মৌলভীবাজারের শিশু কাননের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুহিবুর রহমান ছিলেন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী । এই সময়ে তার বয়স ছিল ১৪ বছর। মুক্তিযুদ্ধা না হয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন একদম কাছ থেকে, সবকটি মিছিলেও ছিলেন অগ্রভাগে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ নিয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ২৭ মার্চ মৌলভীবাজারে প্রথম শহীদ হলেন শহীদ জমির মিয়া ও তারা মিয়া। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ দেশব্যাপী পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে তৎকালিন সময়ে শেরপুর এলাকা থেকে মৌলভীবাজারমুখি ক্ষুব্ধ সাধারণ বাঙ্গালিদের অংশগ্রহণে পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় একটি প্রতিরোধ মিছিল আসতে থাকে।

এই মিছিলটি যত দূর অগ্রসর হয় ততই জনস্রোত বাড়তে থাকে, এক পর্যায়ে তিন শতাধিক মানুষের এই মিছিলটি সরকার বাজার হয়ে মৌলভীবাজার শহরের উপকন্ঠে শ্রীরাইনগর এলাকায় পৌঁছলে হঠাৎ পাক বাহিনীর একটি জিপ মিছিলটির গতিরোধ করলে মিছিলে থাকা লোকজন ভয়ে আতঙ্কে দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকেন । কেউ কেউ মনুর পাড়ের ঝোপঝাড়ের মধ্যে মাটিতে আত্মরক্ষার জন্য হামাগুড়ি দিচ্ছিলেন। এমন সময় জমির মিয়া পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করতে ছুলপি হাতে এগিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনীর সৈন্যরা গুলি চালায়। এসময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন । একই স্থানে গুলি করে হত্যা হয় শহীদ তারা মিয়াকেও ।

তিনি বলেন, ২৭ মার্চ পশ্চিমাঞ্চল সহ অর্থাৎ শেরপুর সরকার বাজার হয়ে যে মিছিলটি একত্রিত হয়ে শহরের দিকে যাত্রা করেছিল সেই মিছিলে জমির ছিলেন। শহীদ জমির গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক পরিবারে সন্তান । ২৭ মার্চের পূর্বের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চে শহীদ জমির পরিকল্পনা করেন ২৭ তারিখে মিছিলে অংশগ্রহণ এবং হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধে যাবার। সেক্ষেত্রে তিনি একমাত্র সম্বল দেশীয় অস্ত্র ছুলফি সান দিয়ে তাতে তেল মাখিয়ে চলে যান সেই প্রতিরোধ মিছিলে। আর সেখানে ছুলফি দিয়ে হানাদার সৈন্যদের দিকে তাক করে ছুড়ে মারতে চাইলে সৈন্যরা তখন গুলি চালিয়ে হত্যা করে জমির ও তারা মিয়াকে। ২৭ মার্চের যুদ্ধে শহীদ হওয়া তিনজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কে আগে শহীদ হয়েছেন এ নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও অনুসন্ধানে জানা যায় এই যুদ্ধে প্রথমে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা জমির মিয়া।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আজিজুর রহমান ২৭ মার্চের পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ২৭ মার্চ সমসাময়িক দিনে দুই দিকেই আক্রমণ হয়েছে। ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার লক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে জেলার বিভিন্ন উপজেলা সফর করতে থাকলে বিষয়টি জেনে যায় পাকিস্থান আর্মির কর্মকর্তারা। সেদিন রাতে শমসের নগরে বৈঠক করে মধ্যেরাতে বাড়ি ফিরি। সে কারনে তারা ২৬ মার্চ ভোর রাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, তৎকালিন সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন করে তাদের সম্পর্কে পাক বাহিনী আগে থেকেই সব তথ্য জানতো । ৭ মার্চ এর পরে আমরা অলরেডি মুক্তিযুদ্ধে অপরেশনের চুরান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি, সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই মূলত ২৮ মার্চ শমসেরনগরে পাক বাহিনীর সাথে সংঘঠিত গেরিলা অপারেশন।

২৭ মার্চ নিয়ে নতুন প্রজন্ম বিতর্কহীন ইতিহাস জানতে আগ্রহী এমন প্রশ্নের জবাবে আজিজুর রহমান বলেন, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন । ২৭ মার্চ লুন্দুর মিয়া, তারা মিয়া ও জমির মিয়াকে পাক বাহিনীর হত্যার বিষয়ে বিতর্কের কোন কিছু নেই । এই তিনজন পৃথক স্থানে পাক বাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন।

তিনি আরো বলেন, এই সময়ে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় মিছিলে থাকা প্রতিরোধ যুদ্ধাদের একমাত্র সম্বল ছিল লাটি-সোটা আর তীর ধনুক। এগুলো দিয়েই তারা হানাদারদের মোকাবেলা করে দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন।

শহীদ তারা মিয়া ও জমির মিয়া ২৭ মার্চ মৌলভীবাজারে সংঘটিত প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ হয়েছেন বলে একমত পোষন করেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১২নং গিয়াসনগর ইউপি চেয়ারম্যান ও তৎকালিন বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের অধীনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী গেরিলাযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা । তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।

(একে/এসপি/মার্চ ২৭, ২০১৮)