সঙ্গীতা ইমাম


পহেলা বৈশাখ, নতুন আরেকটি বছরকে আবাহনের দিন। গত হয়ে যাওয়া বছরটির দুঃখ, কষ্ট, না পাওয়ার বেদনা, বঞ্চনা, মিথ্যাচার, হানাহানি পিছনে ফেলে নতুন প্রত্যাশায় সম্মুখ যাত্রার দিন।

মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে মূলতঃ ব্যবসায়িক কারণে নতুন এই বর্ষ গণনা এবং উদযাপনের শুরু। আজও এ ভূখন্ডের মানুষ আনন্দে উৎসাহে কাটায় দিনটি। আবহমান কালের আনন্দের এই উৎসবটি উদযাপনে থাকেনা ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদ। শাশ্বত মানুষের উৎসব এই বর্ষবরণ।

অধুনা পান্তা ইলিশ বা মাটির শানকিতে পথে বসে খাওয়া বর্ষবরণের আচার কোনদিনও ছিল না। ঘরে ঘরে অন্যদিনের চেয়ে একটু উন্নত আয়োজনের চেষ্টা করতেন অভিভাবকেরা। গরম বলে দই চিড়া থাকতো সকালে। যে পরিবার শাক-ভাত খায় তারা একবেলা মাছ-ভাত খাওয়ার চেষ্টা করতেন, যে পরিবার মাছ-ভাত খান তারা এক টুকরো মাংসের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন, এই প্রত্যাশায় যে বছরের প্রথম দিন ভালো খেলে সারাবছর ভালো খাওয়া যাবে।

এখনকার মতো পোশাক কেনার এতো ধুম সেদিন ছিল না। তবে বাবা মায়ের শখ ছিল সাধ্যের সাথে মিলে গেলে নতুন পোশাক আসতো পরিবারে। নাহলে পুরোন কাপড় পরিষ্কার করে ভোরবেলা রমনার বটমূলে উপস্থিত হওয়ায় কিন্তু কোন আলস্য ছিল না।

শুধু ভালো খাওয়া পরাই না, আমার দাদি বলতেন প্রথমদিন সবার সাথে ভালো ব্যবহার করলে, ভালো হয়ে চললে, ঠিকমতো লেখাপড়া করলে সারাটা বছর এমনই কাটবে। অভিভাবকরা এই দিনটিতে আমাদের পারতোপক্ষে বকতেন না। একে যদি সংস্কার বলি তো সংস্কার। তবে বাঙালির সংস্কার যা এক শুভ আগামির স্বপ্নের সংস্কার।

আমাদের শৈশবে হয়তো এতো চাকচিক্য ছিল না উৎসব উদযাপনে ছিল প্রাণের ছোঁয়া। সাজে ছিল বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির পরিচয়। সুন্দরের প্রতি ছিল মুগ্ধতা ছিল না ছিন্নভিন্ন করার লালসা।
নারী সেদিন নিরাপদেই চলতো আপন স্বাধীনতায়। তখন বেঁধে দিতে হয়নি উৎসব আনন্দের সময়। সংস্কৃতিকর্মীরা গান নাচ আবৃত্তি নাটক নানা পরিবেশনা করেছেন। ব্যবসায়ীরা বেচা কেনা আর হালখাতা করেছেন। সাধারণ মানুষ আনন্দ উল্লাস করেছেন। আর যাদের নিরাপত্তা দেবার কাজ তারা সদাজাগ্রত থেকে নিরাপদ রেখেছেন সকলকে। কোন সমস্যা তো হয়নি। বোমা হামলা তো হয়েছিল সকালে তাতে কি জনগণ এতটুকু ভয় পেয়েছে? বাবার কাঁধে চড়ে শিশুর ডুগডুগির শব্দ কি এতোটুকু কমেছে? বরং জনস্রোত বেড়েই চলেছে একটু একটু করে প্রতিবছর।

যে সাম্প্রদায়িক দুরাচার এই ভূখন্ডকে এর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আবহমান আচার, ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিতে চায় তাকে রুখতে হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। তার ভয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়া বা ঢুকিয়ে দেয়া কোন দায়িত্ববানের কাজ হতে পারে না। যারা সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ধর্মের নামে আমাদের সংস্কৃতিকে বিজাতীয় বলে, আমাদের আচার অনুষ্ঠানকে কটাক্ষ করে পরকালের ভয় দেখিয়ে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত করে, আসুন তাদের নামে অনুভূতিতে আঘাতের মামলা করি সারা দেশের সকল সচেতন মানুষ। এদের প্রতিহত করি এদেরই অস্ত্রে।

শুভ নববর্ষ।
১৪২৫ বঙ্গাব্দ হোক প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্নদায়িকতা মুক্ত একটি বছর।

লেখক : শিক্ষক ও সংস্কৃতি কর্মী।