জামালপুর প্রতিনিধি : ফারমার্স ব্যাংক কেলেংকারীতে আটক যুদ্ধাপরাধী মাহবুবুল হক বাবুল চিশতির ফাঁসি ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে জামালপুরে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও স্বারকলিপি প্রদান করেছে মুক্তিযোদ্ধারা।

জামালপুর শহরের দয়াময়ী মোড়ে রবিবার দুপুরে ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন যুদ্ধকালীন কোম্পানী কমান্ডার সিরাজুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন তাপস, নজরুল ইসলাম, আবুল হোসেন, আলতাফুর রহমান প্রমুখ।

যুদ্ধাপরাধী মাহবুবুল হক বাবুল চিশতি ফাঁসী দাবি করে মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বকসীগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষজনকে হত্যা,বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছিল বাবুল চিশতি। তার বিরুদ্ধে জামালপুর ও শেরপুরে ৩টি যুদ্ধাপরাধী মামলা রয়েছে। সেই বাবুল চিশতি টাকার জোরে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক হয়েছিলেন। সেই সুবাধে জামালপুরের বকসীগঞ্জ ও ইসলামপুর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি থেকে অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্ন্তভুক্তির জন্য সুপারিশ করেছেন। সেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অর্ন্তভুক্তি না করার আহবান জানান মুক্তিযোদ্ধারা। তারা সরকারী চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখারও দাবি জানিয়েছেন।

কে এই বাবুল চিশতি ?

ফারর্মাস ব্যাংক কেলেংকারীর প্রধান নায়ক বাবুল চিশতি জামালপুরের বকসিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম উঠানি পাড়ার নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে। বাবা মেরাজুল হক প্রান্তিক কৃষক ছিলেন। এক সময় অভাবের তাড়নায় জামালপুরে তালুকদার বস্ত্রালয় নামে কাপড়ের দোকানে কর্মচারীর চাকুরি করতেন। শহরের আমলাপাড়ায় বাড়ী ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতে না পেরে জিনিসপত্র ফেলে পালিয়েছিলেন বাবুল চিশতি। সেই বাবুল চিশতি রাতারাতি অঢেল সম্পদ ও দুর্দান্ত ক্ষমতার মালিক বনে যাওয়ায় এলাকায় কেউ বলে রহস্যময়, কেউ বলে মুখোশধারী পুরুষ।

বকসিগঞ্জ উপজেলায় একাধিক লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই চতুরতা প্রতারণায় বেশ জুড়ি ছিল তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তরুন বাবুল চিশতি ১১নং সেক্টরের হেডকোয়াটার ভারতের মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এক মাস ট্রেনিং নিয়ে পালিয়ে এসে কামালপুর পাক বাহিনীর ক্যাম্পে এসে যোগ দেয়। হানাদারদের বিশ্বাস অর্জনে বকসিগঞ্জ উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা,বাড়িঘরে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। যুদ্ধের সময় বকসীগঞ্জের মানুষকে সবচেয়ে বেশী অত্যচার নির্যাতন করেছিল এই বাবুল চিশতি ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বকসীগঞ্জের নওফুল বিবি তার স্বামী হত্যার দায়ে ২০১০ সালে বাদী হয়ে জামালপুর জজ আদালতে ও ঝিনাইগাতীর চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমানকে গো-হাটিতে গুলি করে হত্যার দায়ে তার ছেলে সাইফুল ইসলাম শেরপুর জজ আদালতে যুদ্ধপরাধীর মামলা দায়ের করেন বাবুল চিশতির বিরুদ্ধে।

যুদ্ধপরাধীর মামলা থেকে বাঁচতে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগে যোগ দেন। তিনি সবসময় থেকেছেন ক্ষমতার কাছাকাছি। জাতীয়পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে দাপটের নেতা ছিলেন তিনি। ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে বিএনপি’তে যোগদেন। বকসীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য।

যুদ্ধপরাধী মামলার আসামী রাজাকার বাবুল চিশতি টাকার জোরে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। তিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদকও।

রাজাকার হয়ে বাবুল চিশতি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় যুদ্ধকালীন কোম্পানী কমান্ডার সিরাজুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করলে ফারমার্স ব্যাংক থেকে তার ছেলের বউকে চাকুরীচ্যুত করেন।

মুর্তিমান আতংক হয়ে উঠেন নিজ এলাকায়। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়না। তিনি দিনকে রাত, রাতকে দিন বানাতেন প্রভাবের জোরে। দাপিয়ে বেড়াতেন নিজ এলাকা বকসীগঞ্জসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৪ জেলায়। ব্যাংক লুটের টাকা দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক মহল, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকসহ সবাইকে বগলদাবা করে রেখেছিলেন। তার কথার বাইরে গেলেই মিথ্যা মামলা,হয়রানিসহ নেমে আসতো অত্যচার নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। তার রোষানলে পড়ে সাধারন জনগনই নয় তাঁর নিজ এলাকার বাংলা নিউজের সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমসহ আরো দুই সাংবাদিককে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করে থানায় রাতভর পিটিয়ে জেলে পুড়েছিল।

মানুষকে মিথ্যা মামলায় হয়রনীর জন্য তার বাল্য বন্ধু সরকার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একদল ভাড়াটিয়া স্বাক্ষী পালতো। তিনি সাংবাদিকসহ স্থানীয় লোকজনের বিরুদ্ধে হয়রানীমুলক যত মামলা করেছেন সকল মামলার স্বাক্ষী ছিল রাজ্জাকসহ তার লোকজন। বাবুল চিশতির বহু অপকর্মের সাক্ষী এই রাজ্জাক। এই স্বাক্ষী গোপালকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেই বেড়িয়ে আসবে বাবুল চিশতির অজানা নানা কাহিনী।

ভারতের সিমান্ত ঘেষা বকসীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুরের লাউচাপরা এলাকায় অত্যাধুনিক বিলাশবহুল বনফুল কটেজ ছিল বাবুল চিশতির মধুকুঞ্জ। সেখানেই প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে মদ মেয়ের ব্যবস্থা করতো। উপর লেভেলের কেউ হলে চিশতি নিজে উপস্থিত থেকে ব্যবস্থা করতেন। মোসাহেবীর দায়িত্বে থাকতো সরকার আব্দুর রাজ্জাক। এছাড়াও গোপন বৈঠকসহ সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান নিয়ন্ত্রন হতো এখান থেকেই। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে তার শ্যালক মোস্তফা কামালকে ওই এলাকায় দুই দুইবার ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন কর্তৃত্ব ধরে রাখতে।

অভিযোগ উঠেছে, শ্যালক মোস্তাফা কামালের ব্যাংক একাউন্ট ও সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখলে কেঁচু খুড়তে সাপ বেড়িয়ে আসতে পারে। ফারমার্স ব্যাংকের টাকার কিছু অংশ মোস্তাফা কামালের কাছে গচ্ছিত রয়েছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে।

বাবুল চিশতি গ্রেফতারের পর বকসীগঞ্জের ভয়ার্ত মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে। ফারমার্স ব্যাংক লুটের নায়ক বহুরুপি বাবুল চিশতি গ্রেফতার হওয়ায় খবরে বকসীগঞ্জসহ জামালপুরের মানুষ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

বাবুল চিশতির পুরো পরিবারই ৪২০

মাহাবুবুল হক বাবুল চিশতি মাত্র বাসের হেলপার থেকে হয়েছে একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তার উত্থানের প্রতিটি পদে পদে রয়েছে ছলনা আর প্রতারণা। নিয়োগ বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য ও ঘুষের টাকা নিয়ে বর্তমানে তিনি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার মালিক। তার এই সম্পত্তির বেশির ভাগই ছেলে, স্ত্রী ও শ্যালকদের নামে ।

বাবুল চিশতি পরিবারের ৩ ভাই, মাহামুদুল হক চিশতি (হিরো চিশতি) মাহাবুবুল হক চিশতি (বাবুল চিশতি) মাজেদুল হক চিশতি (শামিম চিশতি)। সর্বশেষ মাহাবুবুল চিশতির ছেলে ব্যারিস্টার রাশেদুল হক চিশতি (রাশেদ চিশতি)।

এই চিশতি পরিবারের প্রতিটি সদস্যই প্রতারক চক্রের গড ফাদার। মাহাদুল হক চিশতি ( হিরু চিশতি) একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধের কিছু দিন পরেই জার্মানি এক মেয়ে করে জার্মানি পাড়ি জমান। ২০ বছর সংসার করে ২টি কন্যা সন্তানও হয়। কিন্তু সংসার জীবনে কুড়ি বছর পর বিশাল পরিমান টাকা নিয়ে এদেশে পালিয়ে আসেন হিরো চিশতি।

চিশতি পরিবারের আরেক সদস্য মাজেদুল হক চিশতি (শামিম) চিশতি বেসিক ব্যাংক কেলেংকারীর মুল গড ফাদার। নামে বেনামে মিলিয়ে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেন এই শামিম চিশতি। বাবুল চিশতি ও শামিম চিশতিই বেসিক ব্যাংকের মুল গডফাদার।

চিশতি পরিবারের সর্বকণিষ্ঠ সদস্য ব্যারিষ্টার রাশেদুল হক চিশতি। তিনি সব সময় ব্যারিস্টার হিসাবে নিজেকে পরিচয় দেন। পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে ইংল্যান্ডের এক আইন কলেজে ভর্তি করান মাহাবুবুল হক বাবুল চিশতি । কিন্তু বছর পেরুতে না পেরুতেই জঙ্গী তৎপড়াতে জড়িয়ে পড়েন রাশেদুল হক চিশতি। উক্ত আইন কলেজ তাকে বহিস্কারও করে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
পরে তরিঘরি করে ফারহানা আহাম্মেদের সাথে বিয়ে করানো হয়। এদিকে প্রচার করতে থাকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের কন্যা ফারহানা আহাম্মেদ।

চিশতি পরিবারের প্রতারক চক্রের মুল গডফাদার হচ্ছে মাহাবুবুল হক বাবুল চিশতি। যিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ ক্ষেত্রে থেকে পালিয়ে এসে এদেশে লুটতারাজ, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর জামালপুর মুক্ত দিবসে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরাও পড়েন। পরে ১৯৭২ সালের ৫ মে পর্যন্ত তিনি জামালপুর সাবজেলে থাকেন। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সাধারন ঘোষনায় তিনি ক্ষমা পেয়ে কারাগার থেকে বের হন।

পরে ২০০৯ সালে তিনি বিশাল অংকের অর্থের বিনিমিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খাতায় নাম উঠান। এর পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের নাম ভাঙ্গিয়ে একের পর এক সরকারী খাস জমি দখল করেই চলছেন। এরই মধ্যে কামালপুর বাজারের প্রায় ২ একর জমি দখল করেছেন।

এরপর তার পিছনে তাকাতে হয়নি। একের পর প্রতারণা করে তিনি সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে উঠে গেছেন। কামালপুর বিডিআর ক্যাম্পে ভুয়া মেজর সেজে গিয়ে ধরাও পড়েন এই মাহাবুবুল হক বাবুল চিশতি। পরে তাকে হেলিকাপ্টারে ঝুলিয়ে ঢাকা আনা হয়।

সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর অপুর্ব কৌশল জানেন এই মাহাবুবুল হক বাবুল চিশতি। নিজের মোবাইল থেকে ওই অন্য মোবাইলে ফোন দিয়েও বাবুল চিশতি। ফোন কেটেই বলেন, মন্ত্রী অথবা সেনাবাহিনী প্রধান অথবা আরও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার সাথে কথা বলছেন তিনি।

(আরআর/এসপি/এপ্রিল ১৬, ২০১৮)