কবীর চৌধুরী তন্ময়


সাম্প্রতিক কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি নিয়ে ঘটনার সাথে অনেক অঘটনাও ঘটেছে। সরকারকে রীতিমত নড়েচড়ে বসাতে বাধ্য করেছে। সে সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আশার আলো দেখিয়েছে। কারণ, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি সবার নজরে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং অনেকের সমর্থনও অর্জন করেছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি কতটুকু যৌক্তিক (?) এটিও সবার ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী বছরে এই সময়ে প্রচার-অপপ্রচার বা নানা গুঞ্জনের মাঝে সামনের তথা তৃতীয় আন্দোলনটা কী নিয়ে হতে পারে এবং সেটার জনসমর্থন কীভাবে অর্জিত হবে বা গ্রহণযোগতা কেমন হবে এটাও বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনটি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দ্বিতীয় আন্দোলন। প্রথম আন্দোলনের সুতিকাগার হয়েই এটি অহিংস থেকে সহিংস হয়ে পড়েছে। প্রথম আন্দোলন শিক্ষার্থীদের ভ্যাট প্রত্যাহার করার দাবি-এটির পক্ষে দল-মত নির্বিশেষে জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষার সুযোগ সাংবিধানিক অধিকার। আর সে অধিকার যত বিনা মূল্যে করা যায় জাতি তত এগিয়ে যাবে। শিক্ষা গ্রহণে নিন্মস্তরের অবহেলিত মানুষগুলো উৎসাহ পাবে। সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করাতে এগিয়ে আসবে-এই চিন্তা থেকেই দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী শিক্ষার্থীদের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের পক্ষে মতামত দিয়েছে।

কিন্তু কোটা প্রথা সংস্কারের দাবির আন্দোলন নিয়ে শুরু থেকে দেশের সুশীল সমাজ পর্যবেক্ষণে ছিল। যার-যার মত করে ছোট ছোট স্যাটাসের মাধ্যমে ফেসবুকে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছে। এটি কখনো আন্দোলনের পক্ষে গেছে আবার অনেকের মতামত ছিল এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে! ধরুন, সরকারি পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ।

এই তথ্য মতে, মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকছে পাঁচ শতাংশ, ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য এক শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ।

আবার আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত যেখানে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার শুরু থেকেই কোটার সুযোগ নিশ্চিত করে সেখানে বাংলাদেশ করছে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর। তাহলে, যারা কোটা প্রথার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে সরকারি চাকরিতে মেধাহীনদের দিয়ে রাষ্ট্র প্রশাসন পরিচালনা করার স্লোগান তুলেছে; মেধাহীন কীভাবে হয় তার তথ্য-প্রমাণের অভাবে এই আন্দোলন বিতর্কিত হয়ে পড়ে।

এখানে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, গত তিনটি বিসিএসের নিয়োগে, যেমন- ৩৩তম বিসিএসের ৭৭ দশমিক ৪০ শতাংশ পদ মেধা কোটা দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। আর ৩৫তম বিসিএসে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ৩৬তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ পদ মেধা থেকে পূরণ হয়েছে। তাহলে এখানেও প্রশ্ন থাকে- আদতে কোটা প্রথার কার্যকর কতটুকু?

আর কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের দাবিগুলোও সরকার বিগত বছরগুলো থেকে পূরণ করে আসছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কোটা সংস্কারের নামে অহিংস আন্দোলনকে সহিংস করার কারণ কী? সরকারের সাথে আন্দোলনরত প্রতিনিধি আলোচনা করার পরেও না মানার কারণ নিয়ে নানা রকমের সন্দেহের বীজ বোপন হয়!

খুব সংক্ষেপে বললে, আমাদের আন্দোলনগুলো তীব্রতর হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু, শহীদদের সংখ্যা আর ধর্ষিতা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার করলে। তখন স্বাধীনতার সপক্ষের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো একটু নড়েচড়ে বসে। মাঠ গরম রাখে। প্রতিবাদ ও শাস্তির দাবি তুলে। আর এই জায়গাটা বার-বার চিহ্নিত করে আঘাত করে স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের সমমনাগোষ্ঠী।

আর ভ্যাট প্রত্যাহারের পর দ্বিতীয় আন্দোলনটিও কোটা প্রথা সংস্কারের নামে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে অৃদশ্যভাবে বেছে নিয়ে আন্দোলনটা শুরু করেছে। যার প্রতিফল দেখা গিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বিরুদ্ধে স্যোশাল মিডিয়ায় ট্রল করার ঘটনা। সে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবি সিদ্দিককে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে, শহীদ হয়েছে! এবি সিদ্দিক জীবিত অবস্থায় মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হলে পরে ছাত্রলীগের এক নেত্রী আন্দোলনকারী এক মেয়ের পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে মর্মে গুজব ছড়ানো হয়।

সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান সাহেবের বাসভবনের ধ্বংসযজ্ঞ! হামলাকারীরা পরিকল্পিতভাবে মাথায় হেলমেট পড়ে ও মুখে কাপড় দিয়ে ঢেকে রুমে-রুমে তল্লাশী করে সকল কিছুতে আগুন লাগানো হয়েছে। লুটপাট করেছে, ভেঙ্গে চুরমার করেছে। তারও আগে বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রার সকল আয়োজনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, মঙ্গল শোভা যাত্রা আর বৈশাখ পালন হিন্দুয়ালী বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বৈশাখকে প্রত্যাখান করা, পয়লা বৈশাখে কালো পোশাক পড়ার জনমত তৈরি করা; যেমনটি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় করা হয়েছিল। এগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাজ নয়।

তাহলে কারা ভিতরে ভিতরে এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছে? কারা পৃষ্ঠপোষক করেছে? আর নেপথ্যে কী টার্গেট ছিল-এই প্রশ্নগুলো এখন ঘুরেফিরে আসছে। আর সে সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়ার সাথে এক শিক্ষকের টেলিফোন আলাপ, ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে। আর আন্দোলন থেকেও হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি না মানলে পরে এক দফা সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তোলা হবে!

এখন তৃতীয় আন্দোলনটি ধীরে-ধীরে সেদিকে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো ইতোমধ্যেই বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েও বলেছে, এই ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরেই এই সরকারের পতন করা হবে। আবার কোটা সংস্কারের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে স্যোশাল সাইটেও তারা পরামর্শকমূলক তাদের নিজেস্ব স্ট্যাটাস ভাইরাল করছে। অনেকে বেশি আকারে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বুস্ট পোস্টও করছে।
এখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রী বা আন্দোলনকারীরা ব্যবহার হচ্ছে। তারাও জেনে বা না জেনে ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে লাশের রাজনীতির চর্চা করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অস্থিতিশীল পরিবেশ করে রাজনীতির নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তাই পরিকল্পিতভাবে কোটা সংস্কারের নামে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিদের সম্মানে আঘাত দেওয়া হচ্ছে। মেধাহীন বলে অপপ্রচার করা হচ্ছে। আর কোটা সংস্কার নয়, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের আন্দোলনটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে বৃস্পতিবার (১২ এপ্রিল) বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক কোটা প্রথা বাতিল নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আন্দোলন প্রত্যাহার বা বাতিল নয়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটা ব্যবস্থা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হল’।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, আন্দোলনকারীরা কোটা প্রথা সংস্কার চেয়েছে, বাতিল নয়। তাহলে বাতিল করা নিয়ে তাদের কোনো কথা নেই কেন? বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের ব্যাপারে তাদের কোনো অনুযোগ, অভিযোগ বা আবদার নেই কেন-এটা আশাকরি, নিজ গুণেই বুঝে নিবেন।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)