জে জাহেদ, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে বৈশাখের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে লোকজ মেলা ও বলীখেলা। বৈশাখী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এখানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হয় আবদুল জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে।

এটাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ১২ বৈশাখ নানা রঙে রঙিন হয়ে বৈশাখ হাজির হয় চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে। নগরায়ণের থাবায় লোকজ উৎসব ক্রমশ হারিয়ে গেলেও চট্টগ্রামে জব্বারের এ বলীখেলা এরই মধ্যে অতিক্রম করেছে শতবছরের ঘর।

নানা প্রতিকূলতার মাঝেও চট্টগ্রামের মানুষ লোকজ এ সংস্কৃতি ধরে রাখায় ব্রিটিশ ফিল্ম বিভাগ ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবে জব্বারের বলীখেলার ছবি ধারণ করে সযতেœ সংরক্ষিত রেখেছে লন্ডনের ফিল্ম আর্কাইভে।

দিন দিন বলীখেলার জনপ্রিয়তা বাড়ছে চট্টগ্রামে। তাই তো ৯ বছর ধরে বৈশাখের প্রথম দিনেই নগরীর সিআরবিতে নানা জৌলুসে হাজির হচ্ছে সাহাবউদ্দিনের বলীখেলা।

একইভাবে বৈশাখ এলে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলীখেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলীখেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলীখেলা ও কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয় ডিসি সাহেবের বলীখেলা।

প্রতিটি বলীখেলাকে ঘিরে আশপাশের এলাকায় বসে বৈশাখী মেলা। তবে আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে লালদীঘি মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া বৈশাখী মেলা। এবার লালদীঘিতে বসবে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার ১০৯তম আসর।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, ‘১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এ প্রতিযোগিতার সূচনা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর এ প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।

বাঙালি সংস্কৃতি লালনের পাশাপাশি বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই আবদুল জব্বার সওদাগর এই বলীখেলার প্রবর্তন করেন।

জব্বারের বলীখেলা ও মেলাকে ঘিরে নগরজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। নগরবাসীর মনে দেখা দেয় বাড়তি আনন্দ। দূর-দূরান্ত থেকে বলীখেলা দেখতে ও মেলায় ঘুরতে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ। তীব্র গরম ও ভিড় উপক্ষো করে সবাই ঘুরে বেড়ায় মেলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। নগরীর আন্দরকিল্লা, বক্সিরহাট, লালদীঘি পাড়, কেসিদে রোড, সিনেমা প্যালেস, শহীদ মিনার সড়ক, কোতোয়ালি মোড়, জেল রোডসহ তিন কিলোমিটারজুড়ে এ মেলার বিস্তৃতি ঘটে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন জানান, দেশের কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ মেলা। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ জব্বারের বলীখেলা হলেও তিন দিনের লোকজ মেলা শুরু হয় ১১ বৈশাখ থেকে।

নিত্যব্যবহার্য ও গৃহস্থালি পণ্যের প্রতিবছরের চাহিদা এ মেলাতেই মেটান চট্টগ্রামের গৃহিণীরা। কারণ হাতপাখা, শীতলপাটি, ঝাড়ু, মাটির কলস, মাটির ব্যাংক, রঙিন চুড়ি, ফিতা, হাতের কাঁকন, বাচ্চাদের খেলনা, ঢাকঢোল, মাটি ও কাঠের পুতুল, বাঁশি, তৈজসপত্র, আসন, চৌকি, খাট, আলমারি, ফুলদানি, তালপাখা, টব, হাঁড়ি-পাতিল, দা-ছুরি, কুলা-চালুন, টুকরি, পলো, বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা, মুড়ি, মুড়কি, লাড্ডু, জিলাপি সবই মেলে এ মেলায়।

চট্টগ্রামকে বলা হয় বীরের শহর। বলী থেকেই এই বীর উপাধি পেয়েছে চট্টগ্রামবাসী। সাধারণভাবে প্রচলিত আছে এখানকার মানুষ দৈহিকভাবে শক্তিশালী। কারণ কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে পালোয়ান উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল।

সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক আহমেদ ইকবাল হায়দার জানান, পহেলা বৈশাখ চট্টগ্রামের ডিসি হিলে বর্ষবরণের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। ‘সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ’-এর ব্যানারে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি আয়োজন করে আসছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতি কর্মীরা।

(জেজে/এসপি/এপ্রিল ২৩, ২০১৮)