চান মিয়া, ছাতক (সুনামগঞ্জ) : ছাতকে একটি বাসায় দীর্ঘ ৬ মাস থেকে সরকারি চালের বস্তা বদল করে বিক্রি করা হচ্ছে খোলা বাজারে। এ অভিযোগ পেয়ে সেখানে অভিযান চালায় ছাতক থানা পুলিশ। এসময় ৪২বস্তা সরকারি চালসহ দু’জনকে আটক করা হলেও ইউপি চেয়ারম্যানের কথিত প্রত্যয়ন পত্র দেখিয়ে চাল ছাড়িয়ে নেয় চক্রটি। ১২ এপ্রিল পৌরসভার গণক্ষাই গ্রামের দিলোয়ার হোসেনের বাড়িতে এঘটনা ঘটে। কিন্তু চাল ব্যবসায়িরা তা বৈধ বলে দাবি করলেও এলাকাবাসি বলছেন তা- অবৈধ। এব্যাপারে নিজেদের গা- বাঁচাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছির উল্লাহ খান ও গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আখলাকুর রহমানের পরস্পর বিরোধি বক্তব্য পাওয়া গেছে।  

সরেজমিন গণক্ষাই এলাকাবাসির সাথে আলাপ করে জানা যায়, গত ৬মাস যাবত দেলোয়ার হোসেনের বাসা ভাড়া নেন গণক্ষাই গ্রামের চান মিয়ার পুত্র কাওছার মিয়া, বাশখালা গ্রামের ফজর আলীর পুত্র রূপা মিয়া ও নির্বাহী অফিসারের গাড়ি চালক মখলিছুর রহমানের পুত্র মাসুদ। ভাড়া নেয়ার পর থেকে রূপা মিয়া ও মাসুদ প্রায় প্রতিদিন রাতে সেখানে ট্রাক ভর্তি সরকারি ওএমএস, টিআর ও কাবিখা কর্মসূচির চাল নিয়ে আসতেন। রাতের অন্ধকারে চাল গুলো সেখানে গুদাম ভর্তি করে রাখা হতো।

আবার রাতেই কয়েকজন শ্রমিক মিলে চালের সরকারি বস্তা বদল করা হতো। রাস্তার পাশে বাসাটি হওয়ায় কালো পর্দা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয় বাসার বারান্দা। যাতে বাইরে থেকে কেউ সহজে ভেতরের কিছু দেখতে না পায়। এলাকাবাসি আরো জানান, প্রতিদিন রাত ১০টার পর থেকে সেই ঘরে কাজ করতো শ্রমিকরা। আবার ভোরের সূর্য ওঠার আগেই সেখান থেকে চলে যেতো তারা।

কখনো দিনের বেলায় তাদের কাজ করতে দেখা যায়নি। বাসার ভেতরে চালের বস্তা সেলাইয়ের মেশিনও সিল ছিল যা- তারা বস্তা বদলের পর নতুন বস্তায় ব্যবহার করতো। নতুন বস্তা তৈরী করে সেগুলো পাঠিয়ে দেয়া হতো শহরের বিভিন্ন চালের দোকানে। এমনই খবর পেয়ে গত ১২এপ্রিল রাতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশ যাবার পর ৪টি গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষ সেখানে ভীড় জমান। ভাড়াটিয়া বাসা থেকে জব্ধ করা হয় ৪২বস্তা চাল। এসময় রূপা মিয়াও মাসুদ নামের ২জনকে আটক করা হয়। কিন্তু পরক্ষনে কাগজ পত্র দেখিয়ে চাল ছাড়িয়ে নেয় চক্রটি এমন অভিযোগ করেন এলাকাবাসি।

বাসার মালিক দিলোয়ার হোসেন জানান, গত ৬মাস পূর্বে গনক্ষাই গ্রামের কাওছারের কাছে মাসিক ২হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া দেন। বাসা ভাড়ার সময় কাওছার জানায় সেখানে সে চালের গুদাম করবে। আমি ছাতক শহরে থাকার কারণে সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল না। গত ১২এপ্রিল রাতে পুলিশ আমাকে ফোন দিয়ে জানায় সেখানে অবৈধ চাল পাওয়া গেছে আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমি যাবার পর পুলিশ বাসার তালা ভাঙ্গার অনুমতি চায়। আমি অনুমতি দেই।

এসময় রূপা মিয়াও মাসুদ আসলে তারা চাবি দিয়ে বাসাটি খুলে দেয়। এসময় গোডাউন ভর্তি সরকারি চাল পাওয়া যায়। পুলিশ প্রথমে চালগুলো জব্দ করলেও পরে বিভিন্ন কাগজপত্র দেখালে তারা এগুলো ছেড়ে দেয়। তিনি আরো জানান, আমি এলাকাবাসির কাছ থেকে জানতে পারি সেখানে প্রায় প্রতিদিন রাতে ট্রাক ভর্তি চাল আসতো। সেগুলো রাতের আধারেই সেখানে বস্তা বদল করা হতো।

এলাকাবাসী এগুলো অবৈধ বলার কারণে আমি তাদেরকে ওই দিনই বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য বলেছি। তারা সেখান থেকে চলে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গনক্ষাই গ্রামের একাধিক মহিলাসহ লোকজন জানান, গত ৬মাস থেকে কয়েকদিন পর পর রাতের আধাঁরে ১/২ টি ট্রাক ভর্তি করে সরকারি চাল এ বাসায় আনা হতো। ভোরের আগেই বস্তা বদল করে ট্রাকগুলো সেখান থেকে চলেও যেতো। যে বস্তা দিয়ে চাল সেখানে আনা হতো রাতের অন্ধকারে আবার সে চালগুলো অন্য বস্তায় ভর্তি করা হতো। বাসার ভেতরে কি হচ্ছে তা- না দেখার জন্য বারান্দায় ভারি কাপড় দিয়ে পর্দা সাঁটানো ছিল। নতুন বস্তায় চাল ভরে তারা তা- নতুন করে প্যাকেট করতো।

আবার রাতের বেলা অন্য ট্রাকে করে চালগুলো অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হতো। বাসার ভেতরে কম্পিউটার, বস্তা সেলাইয়ের মেশিন ও লগো সিলও ছিলো বলে জানান তারা। এসময় তারা অভিযোগ করে বলেন, চালগুলো যদি বৈধ উপায়ে সেখানে আনা হতো তাহলে রাতের বেলায় কাজ না করে তারা দিনের বেলা করতো। ট্রাক গুলোতো মাঝে মধ্যে দিনেও আসতে পারতো। ট্রাকগুলো প্রায় সময় রাতের আধাঁরে আনা হতো কেন? পুলিশ তাদের প্রথমে গ্রেফতার করে পরে কার ফোন পেয়ে ছেড়ে দিল তা- খতিয়ে দেখার বিষয়।

গণক্ষাই গ্রামের মুরব্বী আব্দুল হক জানান, দীর্ঘদিন থেকে এ বাসা ভাড়া নিয়ে চালের ব্যবসা করতো কয়েকজন। তারা কখনো দিনের বেলা এ ঘর খুলতো না। প্রায় রাতে ২/১টি ট্রাকে করে এখানে সরকারি চাল আনা হতো। চালগুলো এখানে আনার পর সেগুলো বস্তা বদল করে আবার রাতের বেলা ট্রাকে করে গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়া হতো। কোথা থেকে এসব সরকারি চাল আসতো তা- এখানের কারো জানা নেই। আর সরকারি চালের বস্তা কেনইবা বদল করে নতুন বস্তায় ভর্তি করা হতো তা- নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিলো।

এ ব্যাপারে রূপা মিয়া জানান, আমি পারিবারিক সূত্রে একজন চাল ব্যবসায়ি। আমি বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। গণক্ষাইয়ে পুলিশ যে চাল জব্দ করেছিলো সেগুলো আমি বৈধভাবে ক্রয় করেছি। আমি গুচ্ছগ্রামের কাবিখা কর্মসূচির ৪২মে.টন চাল গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান আখলাকুর রহমানের কাছ থেকে ৩টি ডিওর মাধ্যমে চাল ক্রয় করেছি। যার ডিও কাগজ আমার কাছে আছে। কি জন্য রাতের অন্ধকারে বস্তা বদল করা হয় এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি রূপা মিয়া।

রূপা মিয়া আরো জানান, সিলেট নগরীর কালিঘাট এলাকা থেকে চাল আমদানী করে এখানে নিয়ে আসি। এখান থেকে আমি ছাতক বাজারে চাল বিক্রি করি।

রাতের অন্ধকারে ট্রাকে করে গণক্ষাইয়ে চাল আনা নেয়া করা হয় এলাকাবাসির এমন অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলেন, সব সময় রাতে আসে কথা ঠিক নয়। এগুলো তার বিরুদ্ধে অপ-প্রচার বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আখলাকুর রহমান জানান, এ বিষয়ে ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য নিন। উনি সবকিছু জানেন।

তিনি আরো জানান, তিনি রূপা মিয়ার কাছে গুচ্ছগ্রামের প্রকল্পের চাল বিক্রি করেছেন একমাস আগে। এর আগের কিছু তিনি জানেন না।

ছাতক উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাছির উল্লাহ খান জানান, গণক্ষাইয়ে জব্ধ করা চালগুলো ছিলো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্ধ প্রকল্পের। এগুলো গুচ্ছগ্রামের কর্মসূচির প্রকল্পের জন্য পিআইসি সভাপতি আখলাকুর রহমান বিক্রি করেছেন। যতটুকু জানি বৈধ উপায়ে ৩টি ডিওর মাধ্যমে সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ সেখানে প্রতি রাতে গাড়ী ভর্তি করে সরকারি চাল আনা হয় প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি এ বিষয়ে অবগত নই।

জব্ধ হওয়া চাল ইউএনওর ফোনে ছেড়ে দেয় পুলিশ এলাকাবাসীর এমন অভিযোগ প্রত্যাখান করে নাছির উল্লাহ খান জানান, আমি কোন ফোন বা সুপারিশ কাউকে করিনি। এ চাল পিআইসির চাল। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ দায়ভার পিআইসি সভাপতি গোবিন্দগঞ্জ-ছৈদেরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আখলাকুর রহমানের।

ছাতক থানার এসআই অরুন দাস জানান, সরকারি চাল মজুদ করে বস্তা অবৈধভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে এমন সংবাদ পেয়ে আমি গণক্ষাইয়ে একটি বাসায় অভিযান পরিচালনা করি। এসময় ৪২বস্তা চালও ২ জনকে সাময়িকভাবে আটক করা হয়। এ সময় তারা এক ইউপি চেয়ারম্যানের একটি প্রত্যয়ন পত্র দেখালে আমরা সেখান থেকে চলে আসি।

(সিএম/এসপি/এপ্রিল ২৬, ২০১৮)