বিশেষ প্রতিনিধি : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর শীর্ষ সন্ত্রাসী বহু মামলার পলাতক আসামী স্বঘোষিত ‘বনমন্ত্রী’ খ্যাত কুখ্যাত ডাকাত আনোয়ার ওরফে আনাইয়া ডাকাতের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দুই লক্ষাধিক জনগণ।

উপজেলার বাইশারী, দোছড়ি এবং পার্শ্ববর্তী রামু উপজেলার গর্জনিয়া, ঈদগড়, মাঝিরকাটা, বড়বিল গ্রাম এবং ঈদগাঁও-বাইশারী সড়কের রাজা তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কুখ্যাত সন্ত্রাসী আনোয়ারের রয়েছে একটি ১০/১২ জনের দুর্দান্ত অপহরণ চক্র। তার নেতৃত্বে এই চক্রটি ঈদগড়, গর্জনিয়া,বাইশারী ও দোছড়িসহ বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জনপদ জুড়ে এবং ঈদগাঁ-বাইশারী সড়কে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী অপহরণ, খুন, ডাকাতি হয়।

রাম রাজত্ব কায়েম করে আইন-শৃংখলার চরম অবনতি ঘটিয়ে আসছিল। গত বছরের আগষ্ট মাসে ঈদগড় করলিয়ামুরা এলাকায় জমির বিরোধ নিয়ে সংঘর্ষে বয়োবৃদ্ধ নজির আহমদ (৬৫) কে নিহতের ঘটনাতেও ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল বলে নিহতের পুত্র হেলাল উদ্দিন দাবী করেন।

গত ৬ মার্চ ঈদগাঁও এলাকার গজালিয়া গ্রামের বৃদ্ধ ছৈয়দুল আলমকে অপহরণ করে দীর্ঘ ৪ দিন যাবৎ গহীণ পাহাড়ে আটকে রেখে ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। বৃদ্ধ ছৈয়দুল আলমকে উদ্ধার করতে ওই সময় ঈদগাঁও,ঈদগড় ও বাইশারী পুলিশের যৌথ টিম পাহাড়ে অভিযান চালায়।

অপহৃত ছৈয়দুল আলম মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলে পুলিশের কাছে কয়েকজন অপহরণকারীর পরিচয় প্রকাশ করিলে বাইশারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এস.আই আবু মুসার নেতৃত্বে সাড়াঁষি অভিযানে অপহরণে জড়িত সক্রিয় সদস্য আব্দু সেলিম (২৭) ও আব্দু সালাম (৩০) গ্রেফতার হয়।

গ্রেফতারকৃত দুজনই পুলিশের জিঞ্জাসাবাদে ও কক্সবাজারের বিজ্ঞ আদালতে কুখ্যাত সন্ত্রাসী আনোয়ার বাহিনীর সদস্য হয়ে দীর্ঘদিন অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানা যায়।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১১ অক্টোবর বাইশারী-ইদগড় সড়কের বেংডেবা নামক স্থান থেকে গাড়ি চালক মো: ইউনূছ,আবদুল করিম ও ব্যবসায়ী আবু বক্করকে অপহৃত হলে মুক্তিপণে ছাড়া পায়।

এছাড়া ২০১৪ সালে ১৯ আগষ্ট লম্বাবিলের রশিদ উল্লাহ, আবদুল খালেক, ২০১৬ সালের ১ মে দৌছড়ি ইউনিয়নের বুলবুল আক্তার, ১২ আগষ্ট বাইশারী ইউনিয়নের রাঙাঝিরি এলাকা থেকে মিজানুর রহমান। একই মাসে দৌছড়ি ইউনিয়নের লংগদু মূখ থেকে ফরিদুল আলম, হুমায়ুন কবির, বরইচর এলাকা থেকে জালাল উদ্দিন, আবদুল কাদের, ২০ সেপ্টম্বর গর্জনিয়া ইউনিয়নের আবদুল আলী ও শামশুল আলম।’

২৩ অক্টোবর বাইশারী পিএসপি রাবার বাগানের পাহারাদার আজিজুল হক, নুরুল আলম,আবদু শুক্কুর, ২৪ আগষ্ট বাইশারী-ইদগাঁও সড়ক থেকে গাড়ি থামিয়ে ছাত্রলীগ নেতা এনকে রাশেদ,ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন ও বাগান মালিক মৌ: হাবিবুর রহমান,২০১৭ সালের ৪ র্ফেরুয়ারী দৌছড়ি ইউনিয়নের লেদুর মূখ থেকে তামাক চাষি ছালেহ আহমদ ও রাজিব।

একই বছরের ৩০ এপ্রিল ঈদগড় এলাকার চাইল্যাতলী হতে শাহ আলম ৫ মে রাঙ্গাঝিরি এলাকার মিজানুর রহমান,মটরবাইক চালক আবু বক্ক্র ছিদ্দিক ২১ নভেম্বর দৌছড়ি ইউনিয়নের বাকঁখালী থেকে নুরুল আজিম, মো: হোছাইন ১৭ ডিসেম্বর বাইশারী ইউনিয়নের আলিক্ষ্যং এলাকার আবুল বশর অপহৃত হয়।

একই মাসে কাগজি খোলা থেকে ছৈয়দ বাবর অপহরণ হয়ে মুক্তিপণে ছাড়া পায়।

২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারিতেও দৌছড়ি ইউনিয়নের লেদুর খাল নামক স্থান থেকে তামাক চাষি আবদুর রহিম, আবু ছৈয়দ, আবুল আজিজ ও শাহ আলম ।

সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল গভীর রাতে দৌছড়ি ইউনিয়নের লংগদুর মূখ থেকে তামাক চাষি সাইফুল ইসলাম (১৮) সহ গত ৪ বছরে শতাধিক রাবার শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্র, ইমাম, কারবারী, জনপ্রতিনিধি ও নারীকে অপহরণ করে আনুমানিক কোটি টাকার মুক্তিপণ বাণিজ্য করে আনোয়ার বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা এ সিন্ডিকেটটি।

সূত্র আরো দাবি করে, এমতাবস্থায় আইন-শৃংখলা বাহিনী এসব কুখ্যাত অপহরনকারী ডাকাতদের আটকে মাঠে নামে। এরই মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল কৃষক সাইফুলকে অপহরণ ও ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় বাইশারী পুলিশের উপ পরিদর্শক আবু মুসার নেতৃত্বে টানা ৩ দিনের অভিযানে অপহরণ চক্রের ৩ সদস্য যথাক্রমে আবদুর রশিদ,শফিউল আলম ও নুরুল হাকিম গ্রেফতার হয়।

গোপন সূত্র দাবি করে, এরই প্রেক্ষিতে আনোয়ার ও তার বর্তমান সেকেন্ড ইন কমান্ড হামিদ ডাকাত চরম প্রতিশোধ নিতে পুলিশের সোর্স, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা আবু মুসাকে হত্যার ছক আঁকে ।

কেননা এ মূসাই সব ডাকাতের আতংক এক পুলিশ কর্মকর্তা বনে যান উপর্যুপুরি অভিযানের কারণে। এতে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণসহ পুরো জনপদ। পাশাপাশি এ ডাকাতদলটি বাইশারী তদন্ত কেন্দ্রের এক সোর্সকে হত্যার জন্যে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে তার বাড়ি ঘেরাও করে।

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাত দলটি গুলি বর্ষণ করতে করতে পালিয়ে যায় পাহাড়ের দিকে।

উপজেলার শীর্ষ এ ডাকাত দলটি নানা মাধ্যমে অল্প দিনের মধ্যে বাইশারীর জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তা বা যে কোন সচেতন লোককে হত্যা করে তাদের দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের বদলা নিতে পারে বলে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করে।

বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম জানান, গত ২০ এপ্রিল গভীর রাতে কে বা কারা তার বাড়ির দরজার বাহির থেকে ধাক্কা-ধাক্কি করে। ভয়ে তার পুরো পরিবার চরম আতংকে রাত যাপন করে কাটায় জেগে থেকেই। এ ঘটনায় তিনি জিডি করেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানায়।

দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ,র‌্যাব ও বিজিবি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগনের সাথে কথা বলে জানা যায়।

একাধিক অপহরণের উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আবু মুসা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে আনোয়ার ডাকাত অতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অপহরণ ও ডাকাতি বন্ধে এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্তি পুলিশ সুপার আলী হোসেন জানান,হত্যার হুমকির বিষয়টি তিনি শুনেছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি এ প্রতিবেদককে আরো জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি ও বাইশারীর অপরাপর সন্ত্রাসীদেরকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আটক করার জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা নিয়ে এস.আই মুসা মাঠে কাজ করে যাচ্ছে।

নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে:কর্ণেল আনোয়ারুল আজিম জানান, বাইশারীর শীর্ষ ডাকাত আনোয়ার ও তার বাহিনীর লোকজন কে গ্রেফতার করতে ইতিমধ্যে পুলিশ, বিজিবির অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তাকে ধরার জন্য অব্যাহত আছে।

(জেজে/এসপি/এপ্রিল ২৮, ২০১৮)