কবীর চৌধুরী তন্ময় 


যেকোনো আন্দোলনের একটা টার্গেট বা উদ্দেশ্য থাকে। শুধু গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল কোনও টার্গেট ছাড়া। ক্ষোভের জায়গা থেকে জাতির বহু কষ্ট-বেদনা আর আশা-প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর মঞ্চ হিসেবে গণজারণের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথম দুইদিন সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে থাকলেও আস্তে-আস্তে সেটি দীর্ঘদিন ধরে চলে। দেশে-বিদেশেও গ্রহণযোগ্য লাভ করে।

সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারসহ পুরো জাতিকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। দেশের নির্বাচনকালীন এই সময়ে এসে কোটা সংস্কারের দাবি, না হয় সরকার পতনের দাবি-তোলা কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ করা হয়।

আর সে সাথে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, প্লে-কার্ডের স্লোগান এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে অহিংসভাবে দাবিপূরণের আন্দোলন কীভাবে সহিংস হয়ে পড়ে সেটা ধীরে-ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। শাহবাগ মোড়ে দীর্ঘ সাড়ে চার ঘন্টা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা আটকে রেখে জনসাধারণের দূভোর্গের চিন্তা আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাথায় ততটা অনুধাবন না হলেও, যাঁরা পর্দার আড়াল থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা সুকৌশলে এই ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহার করেছে। রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা জিম্মি করার অপকৌশল নিয়েছে।

নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে পুলিশ বার-বার বলার চেষ্টা করেছে। বুঝিয়েছে এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তা থেকে তুলে দিতেও চেয়েছে। একপর্যায় আন্দোলনরত কিছু শিক্ষার্থী ফুল নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে আসলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে পুলিশ অন্যত্র চলে যায়। ভেবেছিল, হয়তো কিছুক্ষণ পরেই আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা চলে যাবে। তাঁরা অপরের ক্ষতি সাধন করবে না।

কিন্তু পুলিশের এই চিন্তাধারার বিপরীত ঘটনার অঘটন যা হল-এটা উভয়ের জন্য লজ্জার এবং বিপদ জনক। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর রীতিমত রণক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। অল্প বয়সের এই সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ভিতরের ষড়ন্ত্র কী হতে পারে, তা কোনো পরিসংখ্যান দিয়ে বা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। আর বই-কলম আর কম্পিউটারের সময় ব্যয় করা শিক্ষার্থীরা অতোটা বুঝে উঠার কথাও নয়। আবার শিক্ষার্থীরা বুঝে করেছে-এটা বলার পক্ষে আমি নই। তবে তাঁরা ব্যবহার হয়েছে।

টার্গেটকারীরা এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেছে নিয়েছে কেন (?) সেটাও বিচার-বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসে- ভ্যাট নিয়ে আন্দোলনের পটভূমি। কারণ ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনও সবার নজর কেড়েছিল। ভ্যাটের বিরুদ্ধে এক ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিল আন্দোলরত শিক্ষার্থী। অবশেষে শেখ হাসিনার আশ্বাসের কারণে ওই আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষার্থীরা মাঠ ছেড়ে শিক্ষালয়ে ফিরে যায়। তাই সুকৌশলে এবারও এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়েছে। আর এটা যে রাতারাতির পরিকল্পনা, তাও কিন্তু নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করেছে। অনলাইনে গ্রুপ তৈরি করা, সেখানে সবাইকে অ্যাক্টিভ করা, পক্ষের জনমত তৈরি করা। কীভাবে অর্গানাইজড করা হবে, অনলাইন কীভাবে ব্যবহার হবে, কারা নিয়ন্ত্রণ করবে, কী ধরনের কোড ব্যবহার করে মোবাইলফোন কলে স্থান এবং আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার নিদের্শনার বিষয়াদি; কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীর কাজ নয়।

এই আন্দোলনকে আতঙ্কিত করা, আন্দোলনকর্মীদের উস্কে দেওয়া, আন্দোলনে সম্পৃক্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মানসিক দিকটি জঙ্গি মনোবলে রূপান্তর করার কৌশল ছিল গুজব বা অপপ্রচার ভাইরাল করার মাধ্যমে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবিত শিক্ষার্থী এবি সিদ্দিকের আঘাত পাওয়া ব্যান্ডেজের ছবি নিয়ে ভাইরাল করে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে রটানোর পটভূমিগুলো। তাৎক্ষনিকভাবে গুজবের সফলতা হিসেবে সুফিয়া কামাল হলের গেইটের তালা ভেঙ্গে রাতের অন্ধকারে ছাত্রীদের বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে। জেলা পর্যায়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। জেলা-উপজেলার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকে ঢাকার বন্ধুদের পাশে থাকার আহ্বান-অনুরোধ জানিয়ে স্ট্যাটাসও ভাইরাল করেছে। ছাত্রদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরকে রণক্ষেত্র তৈরি করতেও তাঁরা সক্ষম হয়েছে।

আর এই গুজব বা অপকৌশল তাদের নতুন নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে বেড়িয়ে আসবে। তখনও টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা। একদিকে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে-দেখিয়ে কবর খোলা হয়েছিল অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে-বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ করেছে। আর এইসবের ছবি তুলে মিথ্যাচার করে প্রচার-প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক মহলকে ভিন্ন বার্তা দিতে গুজব রটানোর চেষ্টাও হয়েছে।

আর এই গুজব রটানো চলতে থাকে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়গুলোতেও। তারা জানে কোথায় আঘাত করতে হয়। তাই বার-বার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্ত ছড়ানো, প্রকৃত ইতিহাস পাল্টানো, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে জাতির সামনে মিথ্যাচার করা, শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; ২০০৪ সালে ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে করা জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড ছুড়ে ২৪ জন নেতাকর্মীকে হত্যার পরে সংসদে এবং সংসদের বাইরে গুজব রটানো হয়-শেখ হাসিনার ব্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড ছিল! শেখ হাসিনা গ্রেনেড নিয়ে জনসভায় গিয়েছে-এই গুজব ধোপে না টেকার কারণে পরে জজ মিয়ার নাটক সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বাদাম বিক্রেতা জজ মিয়ার কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করে। লোভ দেখানো হয়, পরিবারের ভরণ-পোষণ করা হবে। মাসে-মাসে টাকা দেওয়া হবে।

শেখ হাসিনাকে প্রায় ২০ বার হত্যাচেষ্টা করেছে। কারণ তারা জানে একমাত্র শেখ হাসিনার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব। শুধু এখানেই নয়, পাকিস্তানী ছায়া রাষ্ট্র থেকে মুল ধারার বাংলাদেশ, মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য-আদর্শের বাংলাদেশ তিঁনিই বিনির্মাণ করতে পারবে। তাই পরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনা এবং তার বিশ্বস্ত ব্যানগার্ড খ্যাত নেতাকর্মী ও ফলোয়ারদের একের পর এক হত্যা ও বিতর্কিত করার কৌশলও নানা সময়ে দেখা যায়।

আর সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্ছ শাস্তির দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হলে। যখন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্বাধীনতার সপক্ষের শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ, কিশোর-নারী এক-কাতারে, যখন নতুন প্রজন্মের সুর্য সন্তান এই আন্দোলনে; তখন পরিকল্পিতভাবে আস্তিক-নাস্তিকের আন্দোলন বলে অপপ্রচার চালিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জোট। ফটোসপে কাজ করা ছবি-ভিডিও, মেয়েদের পতিতা বলে গালাগালি এবং মেধাবীদের ধরে-ধরে হত্যার লিষ্ট তৈরি করা, হত্যা করা। যা আজও চাপাতি হাতে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এবার আসুন কোটা প্রথা নিয়ে- সংবিধানের আলোকে শুরু থেকেই বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা প্রথা ছিল। সংবিধানের ২৯ এর ৩(ক) উপধারায় বলা আছে, “নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১৯৭২ সালে কোটা চালু করেছিলেন উপহার হিসেবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর এই কোটা বাতিল করা হয়। পরবর্তী ২৪ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের এই কোটা দেওয়া হয়নি। কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা দেওয়া হয়নি, কারা দেয়নি এগুলো আজকের কোটা প্রথা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থী জানে কীনা আমার জানা নেই। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালেই এই কোটা ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করেন। নতুন করে যোগ করেন এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা।

বর্তমানে দেশে পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য। প্রতিবন্ধী এক শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ। আর এর কোনো শ্রেণিতে যারা পড়েন না, তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য।

সরকারি পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ।

এই তথ্য মতে, মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকছে পাঁচ শতাংশ, ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য এক শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ।

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত যেখানে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার শুরু থেকেই কোটার সুযোগ নিশ্চিত করে সেখানে বাংলাদেশ করছে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কোটাধারীরা কীভাবে মেধাহীন হয়? যাঁরা সকল পরীক্ষায় পাশ করে শুধু মৌখিক পরীক্ষায় কোটার সুযোগ গ্রহণ করে আদতে কী তাঁরা কোটা কার্যকরের মধ্যে পড়ে (?)-এটাও চিন্তা-ভাবনার বিষয় হয়ে পড়েছে।

আবার গত তিনটি বিসিএসের নিয়োগে, যেমন- ৩৩তম বিসিএসের ৭৭ দশমিক ৪০ শতাংশ পদ মেধা কোটা দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। আর ৩৫তম বিসিএসে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ৩৬তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ পদ মেধা থেকে পূরণ হয়েছে।

আর মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে যে ধরনের স্লোগান তুলে ধরা হয়েছে, তাও যৌক্তিক কীনা সবাইকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে দায়ের করা রিট আবেদন খারিজ করার আগে আদালত রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন বলেন,‘যারা রিট করেছেন, তারা কি কোটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী রিট করেছেন, তিনি কি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পাননি? আর অন্যরাও এই কোটার বিষয়ে সংক্ষুব্ধ কিনা?’ জবাবে আইনজীবি বলেন, ‘রিটকারী এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। অন্য দুজন রিটকারী সাংবাদিক। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী সামনে চাকরির পরীক্ষা দেবেন।’

তখন ওই আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘আপনি বলতে চান, আমি আইনে পাস করেছি, এখন ডাক্তার হতে চাই? তিনি তো এখনও সংক্ষুব্ধ হননি। এটা ভবিষ্যতের বিষয়। এখনও তিনি পরীক্ষা দেননি। তার আগেই তিনি রিট করেছেন? কোটা আছে কী আছে না, সেটা সরকারের পলিসি। আপনি সংক্ষুব্ধ কিনা, ক্ষতিগ্রস্ত কিনা, তা হওয়ার আগেই আদালতে এসেছেন? আপনি তো সাংঘাতিক লোক।’

পাঠক! এখানে বিজ্ঞ আদালতের কথাগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই স্পষ্ট বেড়িয়ে আসে-আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে অংশ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছে-তারা কখনো, কোনো চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কোটা প্রথার কারণে তাঁদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে মর্মে আন্দোলন করছে না। বরং লঙ্ঘন হওয়ার সম্ভাবনার বার্তা থেকে আন্দোলন করছে।

তাহলে কারা এই ভয়ঙ্কর মিথ্যা, অযৌক্তিক বার্তা দিয়েছে? কোটা প্রথার কারণে মেধাহীনরা এগিয়ে যাচ্ছে আর মেধাবীরা অসহায় আর দুর্বল হয়ে পড়ছে বা হবে-এই দুশ্চিন্তার সফটওয়্যার শিক্ষার্থীদের মাথায় সুকৌশলে কারা ঢুকিয়ে দিয়েছে-এই ধরনের প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে।

আর ষড়যন্ত্র কতটুকু গভীরে গেছে-এটি বেরিয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান সাহেবের বাসভবনের ধ্বংসযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করলে! হামলাকারীরা পরিকল্পিতভাবে মাথায় হেলমেট পড়ে ও মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রুমে-রুমে তল্লাশী করে সকল কিছু চুর্নবিচুর্ন করে দিয়েছে।

তারও আগে চারুকলার ভিতরে বৈশাখ উপলক্ষে মঙ্গল শোভা যাত্রার সকল আয়োজনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সকল কিছু ধ্বংস করেছে। হিন্দুদের বৈশাখ কোনও মুসলমান করতে পারে না বলে মঙ্গল শোভা যাত্রার ও পয়লা বৈশাখ বয়কটের ডাক দিয়েছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। উপস্থিত চারুকলার কিছু শিক্ষার্থী অনুরোধ করলে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের দালাল বলে বিষোদগার করে। কিছু আন্দোলনকারীর ফেসবুক জুড়ে বৈশাখে কালো শাড়ী আর কালো পাঞ্জাবী পড়ারও জনমত তৈরির কাজ করেছে। সেটি তাদের নির্দিষ্ট্য গ্রুপেও ভাইরাল করেছে।

এই আন্দোলনের মুল টার্গেট ছিল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততির কোটা। মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও তাঁদের নাতি-পুতি নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় যে হারে ট্রল করা হয়েছে, কোটা প্রথায় মেধার মুল্যায়ন হয় না বলে যেভাবে তথ্য-উপাত্ত ছাড়া মিথ্যাচার করেছে-এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করলে ঘুরে-ফিরে মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবার এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটাকেই টার্গেট করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান। শুধু সেøাগান ধরা হয়েছে কোটা সংস্কার করতে হবে। কোটা সংস্কারের ৫ দফা দাবি সরকার অনেক আগ থেকেই পুরণ করে আসছে। আন্দোলনরত প্রতিনিধির সাথে আলোচনার পর নতুনভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাসে সরকারের সাথে বসা প্রতিনিধি এক মাসের জন্য সময় মেনে নিলেও পরে ছাত্রশিবিরের গ্রুপটি মাঠে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ১৬ এপ্রিল ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচীও ঘোষণা করা হয়েছিল।

সরকারের আশ্বাস পাওয়ার পরেও শিবিরের নেতৃত্বে নতুন কর্মসূচীর ঘোষণা এবং দিন-রাত মাঠে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যুক্তি আন্দোলনকারী শিক্ষাথীদের খুঁজে বের করার অনুরোধ করব। কোটা সংস্কারের দাবির ব্যাপারে এখনি, এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে, নয়তো সরকার পতনের ১ দফা আন্দোলন করার হুমকি প্রদান-এগুলো পুরো আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আর সরকারের ঘোষণার সাথে-সাথে আন্দোলরত সকল শিক্ষার্থীর চাকরি যেহেতু নিশ্চিত না, সেহেতু এই আন্দোলনে স্বাধীনতাবিরোধীগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে লুকানো সম্ভব হলেও-এটি জাতির সত্যিকারের মেধাবীদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

স্বাধনিতাবিরোধীচক্র জানে কোথায় আঘাত করলে তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিল হবে। আর কীভাবে করলে সেটা জনগণ লুফে নিবে। তাই গুজব রটানো তাদের কৌশলের অংশ হয়ে পড়েছে। যেমনি করে যুদ্ধাপরাধী দোলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদের দেখার গুজব, ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে শিশু মরার গুজব, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে তার গুজবের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবি সিদ্দিকির মুত্যুর গুজব ছড়ানো হয়। মৃত এবি সিদ্দিক জীবিত অবস্থায় মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হলে তখন এক ছাত্রলীগের নেত্রী আন্দোলনরত এক মেয়ের পায়ের রগ কাটার গুজুব সৃষ্টি হয়।

এই গুজবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার কৌশলে ছাত্রলীগ নেত্রীকে জুতার মালা পড়িয়েছে। তাকে অর্ধউলঙ্গ করেছে। সেই ভিডিও ভাইরালও করেছে। অন্য ছাত্রীর পায়ের রগ কাটার গুজবের রটনায় সে অপরাধী না হলেও অন্যান্য ছাত্রীদের মারধর করার অপরাধের জন্য আইন আছে, আদালত আছে। আর বিশেষ করে দেশের যে সাংবাদিক সমাজের প্রচার-প্রকাশের কারণে আন্দোলন রাজধানীর বাইরে ছড়িয়েছে, সেসকল গণমাধ্যমকে ইঙ্গিত করে ‘চুতিয়া মিডিয়া’ লেখা প্লে-কার্ড তুলে ধরেছে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট লাইভ কাভারের সময় বেসরকারি টেলিভিশনের এক সাংবাদিকের গাল টেনে ধরার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে। এখানেও নয়। পরিকল্পিতভাবে কিছু সাংবাদিককে শারীরিকভাবে আঘাতসহ মানসিকভাবেও অপমান করেছে। ঠিক যেভাবে হেফাজতের আন্দোলনের সময় করেছিল।

তবে দুঃখজনক হলো, এই গুজবে আমাদের অনেক সচেতন ব্যক্তিবর্গও যুক্ত হয়ে পড়ে অনেক সময়। যাচাই-বাছাই ছাড়াই এই ধরনের অপপ্রচারে নিজের কান অপরের পিছনে খুঁজতে থাকে। আর তখন তাদের ফলোয়ার, ভাই-বোন, বন্ধুও সেটাকে সত্য বলে নিজেরাও যুক্ত হয়ে পড়ে।

কোটা সংস্কার ও আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দেওয়ার মতন তারা কিছু শিক্ষক পেয়েছে। কিছু সাংবাদিক পেয়েছে। কিছু কলামিষ্ট বা বুদ্ধিজীবী পেয়েছে। আইনজীবী পেয়েছে। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ পদ-পদবী ব্যবহার করা কেন্দ্রীয়-জেলা পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মীও পেয়েছে। তারা প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-পুতি নিয়ে ট্রল করেছে। মন গড়া গল্প আর গাল ভরা তথ্য উপস্থাপন করে বলেছেন, এটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপমান। নাতি-পুতিরা দেশের জন্য কি করেছে? তাঁদের টানতে হবে কেন? এটা বাড়াবাড়ি-বলে মতামত তুলে ধরেছে।

পাঠক! কোটা প্রথা সংস্কারের আড়ালে মুলত মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে টার্গেট করা হয়েছে। এই টার্গেট মুক্তিযুদ্ধ সময়কার থেকেই চলে আসছে। আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে এটা স্পষ্ট হয় বৃস্পতিবার (১২ এপ্রিল) বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক কোটা প্রথা বাতিল নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আন্দোলন প্রত্যাহার বা বাতিল নয়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটা ব্যবস্থা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হল’।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, আন্দোলনকারীরা কোটা প্রথা সংস্কার চেয়েছে, বাতিল নয়। তাহলে বাতিল করা নিয়ে তাদের কোনো কথা নেই কেন? বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের ব্যাপারে তাদের কোনো অনুযোগ, অভিযোগ বা আবদার নেই কেন-এটা আশাকরি, নিজ গুণেই বুঝে নিবেন।

আবার তাদের দেওয়া ৬ দফা দাবির মধ্যে কথাও নেই যে সেখানে বলা আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমরা কোটা সংস্কার চেয়েছি; বাতিল নয়। প্লীজ! মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিল করবেন না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ধন-সম্পদ লুট করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তারা যেভাবে অসহায় হয়ে পড়েছে, তাদের ধরে রাখা, তাঁদের জীবনমান উন্নত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমাদের দায়িত্ব।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র কাজে লাগাতে পারেনি। সরকার পতনের আন্দোলন করে শত-শত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেও শেখ হাসিনার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে বিচার-আচার দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে থামানো যায়নি। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির গুজব তুলেও কিছু করতে পারেনি। রাজনৈতিক অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ভিন্ন-ভিন্ন গ্রুপ বা জোট করেও কিছু করার সম্ভাবনা দেখছে না। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীরাও এখানে ব্যবহার হয়েছে। কেউ জেনে। আবার কেউ না জেনেই। সাধারণ শিক্ষার্থী নিজেরা সকল ষড়যন্ত্রের বাইরে না থাকলে কিংবা সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে বড় ধরনের অঘটন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)