শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : শুনতে অবাক লাগাই কথা, তবে এটাই সত্যি যে, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় প্রতি কেজি ধান বিক্রি হচ্ছে ৪শ’ টাকা দরে। সব জাতের ধান নয়, এ হচ্ছে অধিক উৎপাদনশীল ফাতেমা জাতের ধান। এ ধানের মাহাত্ম্যই আলাদা, তাইতো এ ধানের এতো দাম। অনেকটা গল্পের মতেই সে কাহিনী। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মাশকাটা গ্রামের ফাতেমা বেগম এ ধান আবিষ্কার করেছেন, তাই এর নাম হয়েছে ফাতেমা জাতের ধান। বাগেরহাটে কৃষকের মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে এই ফাতেমা ধানের নাম। অধিক উৎপাদনশীল জাতের এই ধান দেশের আমাদের দেশের ধান উৎপাদনের চিত্রটাই পাল্টে দেবে। এমনটাই বলছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। এই অবস্থায় কৃষকরা এখন ছুটছেন ফাতেমা ধানের বীজ সংগ্রহে। 

যেভাবে আবিষ্কার :

কীভাবে এ ধানের আবিষ্কার করলেন নিজেই জানালেন ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে লেবুয়াত ২০১৬ সালে বাড়ির পাশের ধানখেতে হাইব্রিড আফতাব ৫ জাতের ধানের চাষ করেন। সেখানে ওই ধানের মধ্যে আমি ব্যতিক্রম ৩টি ধানের ছড়া (শীষ) দেখতে পাই। ওই ছড়াগুলো সংগ্রহ করে আমার ছেলেকে বলি এ ধানগুলো বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সে প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও মায়ের কথা রেখে পরের বছর জমিতে ওই ৩ ছড়ার ধানের বীজ হিসেবে জমিতে রোপণ করি। ওই বছর তিন ছড়া ধানের বীজে প্রায় আড়াই কেজি উন্নত মানের ধান উৎপাদন হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরে কৃষি বিভাগের লোকেরা খবর পেয়ে আমাদের ধান দেখতে আসেন। আকারে বড় ও ছড়ায় ধানের সংখ্যা বেশি দেখে তারা আমাকে এ ধান সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেন। আমি এ আড়াই কেজি ধানও বীজ হিসেবে পরের বছর নিজের জমিতে বপন করি। এরপর এ বছর ৭৫ শতাংশ জমিতে ওই ধান রোপণ করি। এতে প্রায় ১শ’ ১০ মন ধান হয়েছে। এ খবর স্থানীয় কৃষকরা জানার পরে ধান সংগ্রহের জন্য সবাই আমার বাড়িতে আসতে থাকে। আমারা এ ধান বর্তমানে প্রতি কেজি ৪শ’ টাকা দরে বিক্রি করছি। তারপরও আমরা চাহিদামত কৃষকদের ওই ধান দিতে পারছি না।’

এ ধানের চাষি ফাতেমার ছেলে লেবুয়াত বলেন, ‘মায়ের কথা শুনে ধান লাগাই। পরে ধানগুলো বড় হলে একটু আলাদা রকম দেখতে পাই। ধানের পাতাগুলো বেশি চ্যাপটা এবং ধানের মোচাগুলো বের হচ্ছিল কলার মোচার মত। পরে খুশি লাগলে ধানগুলোর একটু বেশি যতœ শুরু করি। এরপর থেকেই আমাদের এ সফলতা। আমি চাই এ ধানের জাত সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। আশপাশের কৃষকরা আমাদের কাছ থেকে বীজ হিসেবে এ ধান সংগ্রহ করছে।’

ফকিরহাটের চাকুলী গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, এই ধান নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। প্রতিটি ধানের শীষ ১৩-১৫ ইঞ্চি লম্বা, প্রতি শীষে ১ হাজার থেকে ১২শটি ধান রয়েছে। যার ওজন ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম। যা দেশের অন্য কোন স্থানে আছে বলে কারো কাছে শুনিনি। আর এই ভিন্ন জাতের ধান দেখতে প্রতিদিনই অনেক লোক বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে, আমিও এসেছি ধান বীজ সংগ্রহের জন্য। তিনি সরকারী ভাবে ফাতেমার নামেই এই ধানের নামকরণের জন্য সককারের কাছে দাবি জানান।

মোংলা উপজেলার দত্তরমেঠ গ্রামের কৃষানী রীনা বেগম জানান, সকলের আগ্রহ এখন ফাতেমার ধানের দিকে। এই ধান বীজ হিসেবে সংগ্রহ করতে প্রতিদিনই অনেক লোক আসছে শুনে আমিও এসেছি। তিনি নিজেও প্রতিকেজি ৪শ টাকা দরে ৪ কেজি ধানের বীজ কিনেছেন বলে জানান।

সরেজমিনে গিয়ে ও কৃষি বিভাগের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যেকোন জাতের ধানের থেকে সম্পুর্ণ আলাদা। প্রতি গোছে একটি চারা রোপন করা হয়। যা বেড়ে ৮/১২ টি হয়েছে। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। এক একটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬- ৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় দানার সংখ্যা ১ হাজার থেকে ১২‘শটি। যার ওজন ৩০-৩৫ গ্রাম। ধানগাছের পাতা লম্বা ৮৮ সেন্টিমিটার, ফ্লাগলিপ ( ছড়ার সাথের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। ধানগাছের পাতা চওড়া দেড় ইঞ্চি। এই জাতের গাছের কান্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মত এবং অনেক বেশি শক্ত। একর প্রতি ফলন প্রায় ১৩০ মন। অন্য যেকোন জাতের তুলনায় এই জাতের ধান অনেক ব্যাতিক্রম।

অপরদিকে আপতাব- ৫ জাতের হাইব্রীড ধান প্রতি ছড়ায় ১৮০ থেকে ২৫০ টি দানা হয়। এই ধানের বীজ প্রতিবারই বাজার থেকে কিনতে হয়। হেক্টর প্রতি এই ধান উৎপাদন হয় ৫ টন। একই জমিতে কৃষক ফাতেমার উদ্ভাবিত জাতের ধানের উৎপাদন ১১ টন।

ফকিরহাট উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোলায়মান আলী বলেন, ‘যখন ব্যতিক্রম এ ধানগুলি ফাতেমার বাড়ীতে ও মাঠে গিয়ে দেখতে পাই তখন আমার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করি। আমরা এবছর এই ফাতেমা ধান সংগ্রহ করে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠিয়েছি। পাতেমা ধান নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। আমি মনে করি এ ধানই হবে বাংলাদেশের অধিক উৎপাদনশীল জাতের অন্যতম ধান। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।’

ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোতাহার হোসেন বলেন, ‘উপসহকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে এ ধানের সম্পর্কে জানতে পেরে এবছর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে ফাতেমা ধান নিয়ে গবেষণা চলছে। ধানগুলো দেখতে আকারে সাধারণ ধানের চেয়ে কিছুটা বড়। ধানের একটি পাতা প্রায় দেড় ইঞ্চি চওড়া। ধানের গাছগুলো ১৩৫ সে.মি. লম্বা। প্রতিটি ছড়ায় গড়ে ৯৪০টি ধানের দানা উৎপাদন হয়েছে। যা সাধারণ ধানের ছড়ার থেকে ৫ গুণ বেশি। আমরা এবছর নমুনা সংগ্রহের জন্য ধান কেটেছিলাম। সে অনুযায়ী একরে ১৩০ মন ফলন হয়েছে। অধিক উৎপাদনশীল জাতের এই ধান দেশের আমাদের দেশের ধান উৎপাদনের চিত্রটাই পাল্টে দেবে। তবে, এই জাতের ধানটি প্রাথমিক পর্যায়ে লবন সহিষ্ণু হিসেবে আমরা বিবেচনা করছি। কারণ ওই এলাকার মাটি লবনাক্ত এবং চিংড়ি ঘেরের (খামারে) মধ্যে ধানটি চাষ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এ ধানের জাত সম্পর্কে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিস্তারিত জানা যায়নি। যেহেতু ধানটি ফাতেমা সংগ্রহ (অবিস্কার) করেছে। আর ফাতেমার পরিবার চাষ করেছেন। সে কারণে কৃষি বিভাগ এ ধানকে ফাতেমা ধান নাম দিতে চাচ্ছি। বর্তমানে এ ধানের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট ও রাজশাহী থেকে আমাদের কাছে এই ধান বীজ হিসেবে সংগ্রহ করার জন্য অনেক কৃষক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’

বাগেরহাট জেলা বীজ প্রত্যায়ন কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানান, কৃষক পর্যায়ে উদ্ভাবিত ফাতেমা ধান একটি নতুন জাতের ধান। এই ধান নিয়ে পরিক্ষা-নিরিক্ষা চালনো হচ্ছে। কৃষক পর্যায়ে যে এত উন্নত ধরনের ধান উদ্ভাবন হয়েছে তা স্থানীয়দের মাঝে চমক সৃষ্টি হয়েছে। এই বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে ছাড় করানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

(এসএকে/এসপি/মে ১২, ২০১৮)