শরীয়তপুর প্রতিনিধি : দরপত্রের মাধ্যমে সরকার বিদেশ থেকে ১ লক্ষ মেট্রিক টন চাল আমদানি করছেন। এর আওতায় শরীয়তপুরে জেলা সদরের আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদাম ২ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার কথা। ২৫ মে ২০১৮ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদামে  চাল পৌছানোর কথা থাকলেও মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন পরেও সম্পন্ন হয়নি চাল সংগ্রহ। 

এখনো অন্তত ২ শত টন চাল পৌছেনি গুদামে। অথচ মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ দিন আগেই শরীয়তপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে পাঠিয়েছে ২০ মে পুরো চাল বুঝে পাবার তথ্য। ঠিকাদার বলছেন সব চাল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে গত ২০ মে‘র আগে। মাত্র ৬ ঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিয়ে ৬ দিনেও চাল বহনকারি গাড়ি গুদামে না পৌছানোয় প্রশ্ন উঠেছে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা নিয়ে।

ব্যবসায়ী ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে রাস্তা থেকেই সরবরাহকৃত উন্নত মানের চাল নিন্ম মানের চালের সাথে বদল করে আনার কারণে যথা সময়ে গুদামে পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ধারণা অনেকের। অভিজ্ঞদের ধারণা, সরাসরি ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল দেয়ার কথা থাকলেও বেশীরভাগ চালই হতে পারে দেশে উৎপাদনকৃত।

খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার দরপত্রেরে মাধ্যমে প্যাকেজ-৩ এর আওতায় বৈদেশিক উৎস থেকে এক লক্ষ মেট্রিক টন নন-বাসবতি সিদ্ধ চাল আমদানি করছে। চুক্তি অনুযায়ী রশিদ অটোমেটিক রাইচ মিলস্ লিমিটেড দেশের বিভিন্ন জেলার ৫৪টি খাদ্য গুদামে এ চাল সরবরাহ করবে। এর আওতায় শরীয়তপুরে জেলা সদরের আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদাম ২ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করছে।

২৫ মে ২০১৮ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদাম সমূহে চাল পৌছে দেয়ার কথা রয়েছে। আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ মাত্র ১ হাজার ২০ টন চাল গুদামে গ্রহন করলেও মেয়াদ শেষের ৫ দিন আগেই খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুরো ২ হাজার টন চাল বুঝে পাওয়া বিষয়ে। গণমাধ্যমের কাছে এমন জালিয়াতির তথ্য পৌছলে বিষয়টি শরীয়তপুর জেলা প্রশাসককে জানানো হয়।

জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কে তদন্ত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ইউএনও জিয়াউর রহমান মাত্র কয়েক মিনিট লোক দেখানো তদন্ত করে জানিয়ে দেন অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক মহোদয় তলব করেন। সম্পূর্ন চাল গুদামে সংগ্রহ না করেও পুরো চাল বুঝে পাওয়া বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের চলতি মজুদ বিবরনী জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া হলে পরে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের গত বৃহস্পতিবার বিকেলে আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রান্ত কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ আলম দীনাকে এ মর্মে তিন ঘন্টার মধ্যে সন্তোষজনক লিখিত জবাব দিতে মৌখিক আদেশ প্রদান করেন।

সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ তারিখে রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলস্ এর সাথে সরকারের চুক্তি হয় ২৩ মার্চের মধ্যে সকল কেন্দ্রে চাল পৌছে দেয়ার জন্য। নির্ধারিত সময়ে চাল সরবরাহ করতে না পারায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার চাল হস্তান্তরের সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করেন ২৫ মে ২০১৮ পর্যন্ত। ৪ মে থেকে আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদাম চাল সংগ্রহ শুরু করে।

সূত্র জানিয়েছে, সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ৫০ কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ডাবল সেলাইযুক্ত পলি ব্যাগে চাল সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি ব্যাগের গায়ে খাদ্য অধিদপ্তর ও সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানের সীল মোহর সংযুক্ত থাকা বাধ্যতা মূলক। সরবরাহকৃত চাল বুঝে নিতে গুদাম ভিত্তিক একটি কোয়ালিটি ভ্যারিফিকেশন কমিটি (চালের মান যাচাই কমিটি) গঠন থাকতে হবে।

এ কমিটিতে থাকবেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা, একজন কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক ও খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। উল্লেখিত কমিটি সংগ্রহ নীতিমালার নির্দেশনা অনুযায়ী গুদামে চাল গ্রহনপূর্বক খামাল গঠন করবেন। চাল খামালীকরনের পর চালের আদ্রতা (চালের প্রাকৃতিক জলীয় অংশ) সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ আছে কিনা তা নিশ্চিত করবেন।

চালের ভাঙ্গা দানা, আস্ত দানা ও মরা দানা যাচাই করবেন। এরপর শতভাগ বস্তা গননা নিশ্চিত করে কমিটি তিনটি প্রতিনিধিত্বমূলক নমূনা সংগ্রহ করবে। প্রথম নমূনা সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদামে, দ্বিতীয় নমূনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে এবং তৃতীয় নমূনাটি সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানকে পাঠাবেন। এতগুলো ধাপ অতিক্রমের পরে খাদ্য বিভাগ নির্ধারিত ট্রেজারী ব্যাংক বরাবরে ডব্লিউ কিউ এস সি (ওজন মান যাচাই সনদ) প্রদান করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সরবরাহকারিকে প্রতি মেট্রিক টন চালের বিপরীতে ৪২ হাজার ২ শত ৭৫ টাকা পরিশোধ করবেন।

খাদ্য গুদামের তথ্য মতে, গত ২০ মে পর্যন্ত গুদামে ১ হাজার ২০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। সে অনুয়ায়ী শরীয়তপুর সোনালী ব্যাংক রশিদ অটো রাইচ মিলস্ লিমিটেডকে ২২ মে ৪ কোটি ৩১ লক্ষ ২০ পরিশোধ করেছেন বলে জানিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. হাবিবুর রহমান। কিন্তু গত ২২ মে মঙ্গলবার শরীয়তপুর খাদ্য বিভাগ ঢাকা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে যে, ২০ মে ২০১৮ তারিখেই দুই হাজার টন চালের সমূদয় বুঝে পাওয়া গেছে। কিন্তু গুদামে আমদানিকৃত চালের মজুদ অনুযায়ী ২৫ মে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬ শত মেট্রিক টন চাল গ্রহন করা হয়েছে। আরো প্রায় ২ শত টন চাল ভর্তি ১০টি ট্রাক বাইরে অপেক্ষমান। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বাকি প্রায় ২ শত টন চাল গেল কোথায়। আর মাত্র ১ হাজার ২০ টন চাল গুদামে থাকতে অধিদপ্তরকে কেন ৫ দিন আগেই তথ্য দেয়া হলো পুরো ২ হাজার টন বুঝে পাবার ?

আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামে গিয়ে দেখা গেছে, সীল থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া সত্বেও অধিকাংশ চালের বস্তায় কোন সীল নেই। অতি পুরনো ৫০ কেজির পলি বস্তায়ই এসেছে শত শত টন চাল। চটের বস্তায় চাল সরবরাহের আদেশ না থাকলেও অন্তত দেড় শত টন চাল এসেছে চটের বস্তায় ভরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য প্রদানকারি জানিয়েছেন, একটি গুদানে অন্তত সাড়ে ৩ শত টন চাল রয়েছে পুরনো ও পোকায় ধরা। চটের বস্তায় আমদানিকুত চাল থেকে পোকা বেরুচ্ছে। জানা গেছে, চালের মান যাচাই কমিটি নিয়মানুযায়ী যাচাই বাছাই না করেই নিন্ম মানের চাল গ্রহন করেছেন।

খাদ্য ব্যবসার সাথে জরিত একটি সূত্র জানিয়েছে, আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা সরবরাহকৃত উন্নত মানের চাল বহনকারি সংশ্লিষ্ট ট্রাক চালকদের সাথে যোগসাজসে গুদামে পৌছার আগেই মাদারীপুর জেলার জনৈক ব্যবসায়ীর সহায়তায় বস্তা বদল করে ভালো চালের বিনিময়ে নিন্ম মানের চাল এনে গুদামজাত করছে। এতে প্রতি মেট্রিক টন চালে ১০-১৫ হাজার টাকা বিনিময় মূল্য পাচ্ছে খাদ্য কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ আলম দীনা।

খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে শাহনেওয়াজ আলম দীনা আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি) হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এখানে যোগদানের পর থেকেই খাদ্যগুদামে ব্যাপক অনিয়ম শুরু হয়ছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক ধরনরে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ওসিএলএলডি দী না খাদ্য বিভাগের সুনাম ক্ষুন্ন করছেন। সরকারি কর্মসূচির খাদ্য শস্য ওজনে কম দেয়া, অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে হাত মিলিয়ে উন্নতমানের চাল গুদাম থেকে বাইরে বের করে দিয়ে গুদামে নিন্ম মানের চাল-গম প্রবেশ করানো সহ নিয়ম ভহির্ভূত নানা কাজে তিনি জরিয়ে পরছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে শরীয়তপুর বিসিক শিল্প নগরীর তালুকদার ফ্লাওয়ার মিলের জন্য বরাদ্দকৃত ৩০০ মেট্রিক গম সরবরাহ নিয়ে দূর্নীতির ব্যাপক দূর্নীতি করেন খাদ্য কর্মতর্কা দীনা। ৩০০ টন গমের মধ্যে তিনি তালুকদার ফ্লাওয়ার মিলকে ১৪ মেট্রিক টন গম ওজনে কম দেন। এ বিষয়ে মিলের পরিচালক আজিজুল হক মীর মালত শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন।

আজিজুল হক বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে সরকার ৩ শত মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দিলে আমি গত জানুয়ারী মাসে সে গম খাদ্য গুদামে উত্তোলন করতে গেলে ওসিএলএসডি আমাকে মেয়াদ উত্তীর্ণ, পচা, পোকায় খাওয়া গম সরবরাহ করে। আমি গম বুঝে নিতে গিয়ে দেখি আমাকে মোট ১৪ মেট্রিক টন গম কম দেয়া হয়েছে। যার মূল্য প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। এ বিষয়ে আমি শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করলে তিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি যথাযথ তদন্তে বিষয়টি সঠিক প্রমানতি করেন। কিন্তু কতিপয় রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে ওসিএলএসডি এর বিরুদ্ধে কমিটি কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করে আমাকে ১৪ টন গমের সমূদয় মূল্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফেরৎ দিয়ে দেয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদারীপুরের একজন খাদ্য ব্যবসায়ী বলেন, ওসিএলএসডি দীনা মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া খাদ্য গুদামের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্যাপক দূর্নীতি করে। তার বিরুদ্ধে আমরা খাদ্যমন্ত্রী, খাদ্য বিভাগের মহা পরিচালক, আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা প্রশাসন, দূর্নীতি দমন কমিশন সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করি। আমাদের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকে একটি মামলা হয়। এরপর ২০১৭ সনের এপ্রিল মাসে তাকে মাদারীপুর থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলস্ লিমিটেড এর জেনারেল ম্যানেজার হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা ২০ মে‘র আগেই চুক্তিকৃত সকল চাল বহনকারি ট্রাক সংশ্লিষ্ট গুদাম গুলোতে পাঠিয়ে দিয়েছি।

আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ আলম এর কাছে অনিয়ম বিষয়ে জানতে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশনা আছে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছার কোন তথ্য প্রদান করা যাবেনা।

শরীয়তপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক খোন্দকার নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি, আমি অসুস্থ্য মানুষ। এ বিষয়ে আমি কোন কিছু বলতে আগ্রহী নই।

(কেএনআই/এসপি/মে ২৬, ২০১৮)