স্টাফ রিপোর্টার : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সতর্ক করে গত ২৩ মে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সে বিজ্ঞপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।

প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার পর এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও এবার রাঘব বোয়ালদের বাদ দিয়ে চুনোপুঁটিদের অভিযুক্ত করায় বির্তকের মুখে পড়েছে মঞ্জুরি কমিশন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরাও প্রশ্ন তুলেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়ায় গত ফেব্রুয়ারিতে ৩২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শোকজ এবং এর মধ্যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় সেগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে। কিন্তু গণবিজ্ঞপ্তিতে এ তালিকার ১২টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে।

সূত্র জানায়, গণবিজ্ঞপ্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর সে তালিকা যায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। এরপর ইউজিসির চেয়ারম্যানের টেবিলের এক সপ্তাহ আটকে থাকার পর প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। অভিযুক্ত না হওয়ার পরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নতুন করে তালিকায় ঢুকানো হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

এ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত ছিল অভিযুক্ত সবার বিরুদ্ধে গণহারে সর্তক করে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার। কিন্তু ইউজিসি তা না করে নামসর্বস্ব কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে সতর্ক করলেও রাঘব বোয়ালদের ছাড় দিয়েছে। এটাকে ম্যানেজ বিজ্ঞপ্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে ইউজিসির চেয়ারম্যানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট শাখার উপ-পরিচালক জেসমিন পারভীন বলেন, এ ব্যাপারে কথা বলার এখতিয়ার কেবল চেয়ারম্যানের।

গত ২৩ মে ইউজিসির গণবিজ্ঞপ্তিতে ২৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সতর্কতা জারি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মালিকানা দ্বন্দ্ব, অনুমোদন না নিয়ে ক্যাম্পাস চালানো এবং কোর্টের আদেশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা, ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার নামে ক্যাম্পাসে ভর্তির ব্যাপারে সতর্কতা করা হয়। তবে অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস নিয়ে ঘাপলা করেছে ইউজিসি।

সেখানে বলা হয়, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চট্টগ্রামের ক্যাম্পাসের বাইরে ধানমন্ডির ৬৩ সেন্ট্রাল রোডে অনুমোদিত ক্যাম্পাস আছে বলে জানানো হয়। কিন্তু গত ১৫ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত ক্যাম্পাস বন্ধ করেছে বলে ইউজিসিকে জানানো পরও তাদের নামে সর্তকতা জারি করেছে। দি পিপলস ইউনিভার্সিটি রাজধানীর আসাদ এভিনিউর বাইরে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে অননুমোদিত একটি ক্যাম্পাস ২০১৫ সালে বন্ধ করার পরও এ ক্যাম্পাসের নামে সর্তকতা জারি করা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, রাজধানীর শুক্রবাদ এলাকায় মার্কেট দখল করে এবং ডজনখানেক ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম চালাচ্ছে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি। তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার দাবি করলেও বেশির ভাগ কার্যক্রম ভাড়া বাড়িতেই চলছে। শুধু তাই নয়, স্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম চালানোর অনুমতি নিয়ে ভাড়া বাড়িতে ভর্তি নেয়া হচ্ছে। আর উত্তরাতে রয়েছে আরেকটি ক্যাম্পাস। যেখানে প্রকাশে ছাত্র ভর্তি করানো হয়। শুধু এটিই নয়, আরও বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেলেই ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে রাস্তায় নামানোর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভয়ও দেখানো হয়। রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমল সংলগ্ন সিটি ক্যাম্পাস চালাচ্ছে সিটি ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ক্যাম্পাস সাভারের হলেও এখানে ভর্তি থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম চলে।

এ ক্যাম্পাসের অনুমোদন না থাকায় সরজমিন পরিদর্শনে যান সাবেক এক শিক্ষা সচিব। পরিদর্শন শেষে এটা বন্ধে প্রতিবেদন দেয় ইউজিসিকে। তবে তিন বছরের বেশি সময় হওয়ার পরও তা বন্ধ হয়নি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার।

রাজধানীর বনানীতে মূল ক্যাম্পাস হলেও ফার্মগেট ও নিউমার্কেটে ক্যাম্পাস চালাচ্ছে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এটির মালিক হলেও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিষদের একজন রয়েছেন এর পিছনে।

ধানমন্ডির ৩ নম্বর রোডের ১৫/২ নম্বর বাড়িতে পরিচালনার অনুমতি রয়েছে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির। কিন্তু তারা রাজধানীর আরও ডজনখানেক ঠিকানায় কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব ক্যাম্পাসের কোনোটিই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত নয়।

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) একইভাবে পাঁচটির বেশি অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে রাজধানীতে। তিন বছর আগে অনুমোদন পাওয়া সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির মহাখালীর একটি ঠিকানায় ক্যাম্পাস অনুমোদন দেয়া হলেও কারওয়ান বাজারের ৭১নং বাড়িতে অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। যার পাশেই মাছের আড়ৎ। স্বাভাবিকভাবে এ রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। সেখানে দিব্যি কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক একজন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান একজন মন্ত্রী জড়িত।

শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি রাজধানীর উত্তরায় অনুমোদন ছাড়াই একাধিক ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। একই ধরনের অনিয়ম করছে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি। আরও বেশ কয়েকটি ভালো ও মধ্যম মানের দাবিদার বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ক্যাম্পাস রয়েছে যা ইউজিসির অনুমোদন নেই। কিন্তু ইউজিসির নজরে নেই এসব ক্যাম্পাস।

ইউজিসির গণবিজ্ঞপ্তি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, আইন সবার জন্য সমান হওয়ার উচিত। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে একাধিকবার বলা হয়েছে। কিন্তু বরাবরই তারা দ্বিমুখী আচরণ করে।

এ ব্যাপাারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, যারা আইন মানবে না তাদের ব্যাপারে আমরা কঠোর হব। এর আগে তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে যে, কেন তারা (কর্তৃপক্ষ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও আইনের বিধান প্রতিপালন করেনি।

(ওএস/এসপি/মে ২৬, ২০১৮)