হেদায়েতুল ইসলাম বাবু : রমজান শুরুর সাথে সাথে তপ্ত কড়াইয়ের পাশে বসে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন গাইবান্ধার মুড়ির গ্রামের নারীরা। ধান কেনা, সিদ্ধ-শুকানো, ভানাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে মুড়ি ভাজার পালা।

সকাল-সন্ধ্যা বা দিনরাত নেই বিরামহীন সকাল-সন্ধ্যা বা দিনরাত নেই বিরামহীন কাজ করছেন তারা। দিনরাত কাজ করলেও তারা মুড়ির ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র হাত বদল করেই লাভবান হচ্ছেন পাইকাররা।

গাইবান্ধা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জগৎরায় গোপালপুর গ্রাম। সেখানে গিয়ে একটু ডানে মুড়ির গ্রাম হিসেবে খ্যাত বৈরাগীপাড়া। সেখানে এখন শতাধিক পরিবারের মহিলাদের ব্যস্ততা ও ছোটাছুটির শেষ নেই। রমজানকে কেন্দ্র করে তাদর ব্যস্ততা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধান কেনা, সিদ্ধ, শুকানো, মিলে ভানার পর চাল তৈরি করা এবং মুড়ি ভাজার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন তারা। মুড়ি ভাজার তারা পাইকারদের হাতে তুলে দেন। পাইকাররা শহরের বিভিন্ন দোকান ও বাসা বাড়ীতে বিক্রি করে। ভেজালমুক্ত হওয়ায় এই মুড়ির চাহিদাটাও একটু বেশী। গাইবান্ধা ছাড়িয়ে আশেপাশের জেলাগুলোতেও এই মুড়ির কদর কম নয়।

তবে মুড়ি তৈরির এই পেশার সাথে যারা দীর্ঘদিন ধরে জড়িত তারা ভালো নেই। মুড়ির কারিগর জয়ন্তি রাণী জানালেন, ধানসহ সকল উপকরনের দাম বেশী হওয়ায় আগের মতো আর লাভ করতে পারেন না তারা। তিনি বলেন, সারাদিন আগুনের পাশে বসে কাজ করতে শরীরের বারোটা বেজে যায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মুড়ি তৈরি করলেও তাদের কোন লাভ নেই। পাইকাররা তাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি মুড়ি ৫০ টাকা কেজি দরে কিনে বিক্রি করে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। শুধু মাত্র হাত বদল করেই এক কেজি মুড়িতে তারা ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভ করে।

মুড়ির গ্রামের দীর্ঘদিনের কারিগর মুক্তা বেগম বললেন, মুড়ির ব্যবসাই তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। কারণ অন্য কোন কাজ না জানায় এই পেশা তারা ছাড়তে পারবেন না। বাজারে রাসায়নিক ইউরিয়া সারের মিশ্রনে মেশিনের তৈরি মুড়ির দাম কম হওয়ায় তাদের দেশী মুড়ির চাহিদা কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন ওইসব মুড়ির ক্ষতিকর দিক উপলব্ধি করে মানুষ আবারো দেশী মুড়ির খোঁজ করছেন। তবে জ্বালানী, লবণ সহ মুড়ি তৈরির যাবতীয় উপকরনের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পুষিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। পাইকাররা তাদের কাছ থেকে ৫০ টাকা দরে প্রতি কেজি মুড়ি কিনলেও বাজারে বিক্রি করছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। পুঁজি না থাকায় রমজান মাসে যেখানে প্রচুর লাভের মুখ দেখার কথা সেখানে লোকসান গুণে তারা পাইকারদের হাতে কম দামে মুড়ি তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
মুড়ির ব্যবসায়ী নেরোপতি মহন্ত জানান, সাধরনত এক মণ ধান থেকে মুড়ি উৎপন্ন হয় ২২ কেজি। যার পাইকারী মুল্য ১১শ’ টাকা। অপরদিকে স্থানীয় বাজারে প্রতিমণ ধানের দাম এখন প্রায় সাড়ে ৮শ’ টাকা। একমণ ধানের মুড়ি তৈরি করতে একজন মহিলার সময় লাগে দেড় থেকে দুই দিন। শ্রম, জ্বালানি, ধানের দামসহ একমণ ২২ কেজি মুড়ি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১ হাজার টাকা।

মিনতী রাণী জানান, পাইকারদের কাছে অগ্রিম টাকা নেয়ার কারণে মুড়ি তাদেরই দিতে হয়। নিজের টাকা থাকলে মুড়ি তৈরীর সাথে জড়িতরা নিজেরাই বেশি লাভে বিক্রি করতে পারতো।

এলাকার স্কুল শিক্ষক নুর আলম জানান, গ্রামের অন্তত: ১শ’ পরিবারের নারীরা মুড়ি তৈরীর কাজ করেন। এই রমজান মাসে তাদেরকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দেয়া গেলে তারা দ্বিগুণ আয় করতে পারতেন। এতে সংসারের খরচ মিটিয়েও তাদের হাতে বেশ কিছু টাকা জমতো।

এ ব্যাপারে রামচন্দ্রপুর ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, পূঁজির অভাবে গোপালপুরের মুড়ির গ্রামের মুড়ির কারিগররা চাহিদা অনুযায়ী মুড়ি সরবরাহ করতে পারছে না। সরকারী সহায়তা ও প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হলে তারা স্বাবলম্বী হতে পারেন।

গাইবান্ধা বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান জানান, এই মুহুর্তে তাদের সহযোগিতা করার মতো অবস্থা নেই। তবে মুড়ির কারিগরদের বিষয়টি বিবেচনায় আছে।


(এইচইবি/এটিআর/জুলাই ১১, ২০১৪)