স্টাফ রিপোর্টার : অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতি ১৫ দফা নির্দেশনার নীতিমালা দিয়েছে হাইকোর্ট।

গাইবান্ধার দায়রা আদালতের একটি সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলার রায়ে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্দেশনাসহ এই রায় ঘোষণা করেন।

সোমবার সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান রায় প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

রায়ে বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান ও এ সংক্রান্ত মামলা সঠিকভাবে পরিচালনায় বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিম, আমলে গ্রহণকারী হাকিম ও দায়রা আদালতের জজদের প্রতি এ নির্দেশনা পালন করতে বলা হয়েছে। এ নির্দেশনা জানাতে গাইবান্ধার জেলা ও দায়রা জজকে ১৫ দিনের মধ্যে ওই জেলার আদালতের সব বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে (হাকিম) নিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় সম্মেলন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এই নীতিমালা সংবলিত রায়ের কপি সব জেলা জজ, মহানগর ও দায়রা জজদের মাঝে বিতরণ করতে অথবা ওয়েবসাইটে প্রকাশের মাধ্যমে জানানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, দায়রা আদালতের বিচারকদের ফৌজদারি রিভিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধীনস্থ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনায় শুধু সম্মত বা অসম্মত উল্লেখ করেই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না; সংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়বস্তুর সঙ্গে জড়িত আইনগত প্রশ্নের গভীরে ঢুকে অনুসন্ধান এবং তার পর তাদের মেধা ও দক্ষতা অনুযায়ী নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে তারা কাঠামোগতভাবেই বাধ্য, তাদের অবশ্যই বিচারিক মনোভাবসম্পন্ন হতে হবে এবং যেকোনো আদেশের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিশনাল বিষয়সমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যাতে করে সাধারণ জনগণ আদালতের দুর্বল ও শ্লথগতির কারণে কোনো মামলার তদন্ত অথবা বিচার বিলম্ব হচ্ছে বলে দোষারোপ করতে না পারে।

অবসরে যাওয়ার আগে এদেশের অনেক সরকারি কর্মকর্তা তাদের দায়িত্ব পালনের প্রতি অনীহা দেখানোর প্রবণতা ধারণ করে এবং ঢিলেঢালা স্টাইলে কাজ শুরু করেন। বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজদের ওই ধরনের মানসিকতা ধারণ করা যাবে না। উপরন্তু তাদের দায়িত্ব পালনে আরও সিরিয়াস হতে হবে, সৎ, মেধাবী, সজাগ এবং দক্ষ অফিসারদের দ্বারা পরিচালনার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গতিশীল ও দেশপ্রেমী অঙ্গ হিসেবে জনগণের স্বীকৃতি আদায়ে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) এবং মুখ্য বিচারিক হাকিমের (সিজেএম) সহযোগিতায় সব বিচারক এবং হাকিমদের নিয়ে জেলা/মহানগর দায়রা জজের অফিসে মাসে কমপক্ষে একবার জুডিশিয়াল কনফারেন্স (বিচারিক সম্মেলন) করতে হবে।

বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিমের জন্য নীতিমালা

নারাজি পিটিশনে যেসব সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয় তাদের কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিমের (ম্যাজিস্ট্রেট) প্রাথমিক দায়িত্ব। অনুসন্ধানকারী হাকিমের কাছে যেসব সাক্ষী প্রাসঙ্গিক মনে হয়, তাদের বক্তব্যও নিতে হবে। যদি নারাজি পিটিশনে করা অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় মনে হয় তাহলে বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিমকে সম্ভব হলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে হবে। বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকালে একজন হাকিমের কাছে যদি কোনো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কোনো মতামত বা ফাইন্ডিংস যোগ করতে হয়, তা হলে ওই হাকিমকে বিচারিক সাক্ষীদের আচরণ/মানসিক অবস্থা রেকর্ড করতে হবে, একজন বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে তার অনুসন্ধান অবশ্যই যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে।

আমলে গ্রহণকারী হাকিমের জন্য নীতিমালা

আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে একজন হাকিমকে প্রসিকিউশন ম্যাটেরিয়ালস (বিচার্য বিষয়সমূহ) যেমন এফআইআর, স্কেচ ম্যাপ, ইনডেক্স, সিজার লিস্ট, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান প্রতিবেদন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় সাক্ষীদের দেওয়া জবানবন্দি, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, কেস ডায়েরি গভীরভাবে নিরীক্ষা করতে হবে। যদি সেখানে কোনো বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান থাকে, তা হলে আমলে নেওয়া হাকিমকে ওই বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সকল বিষয় অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে, একটি সিআর মামলার ক্ষেত্রে যখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় বক্তব্য নেয়, তখন তাকে সংক্ষিপ্তভাবে বাদীর বক্তব্য রেকর্ড করতে হবে যাতে যে কেউ সহজেই অভিযোগের ধরন বুঝতে পারে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় নেওয়া বক্তব্য থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, তাতে অপরাধ আমলে নেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রাথমিক উপাদান (প্রইমাফেসি) রয়েছে, এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধরায় মামলা হলে ম্যাজিস্ট্রেটকে অবশ্যই ‘আলেয়া ভার্সেস স্টেট’ মামলায় দেওয়া গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে, যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়ার পূর্বে একজন হাকিমকে অবশ্যই আমলে নেওয়ার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে হবে।

আমলে গ্রহণকারী হাকিমকে বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিম বা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার প্রস্তাব বা সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বা বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিমের প্রতিবেদনে কোনো অভিযুক্তের নাম সুপারিশ না করে থাকলেও আমলে গ্রহণকারী হাকিমের উক্ত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে। কোনো আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হলে অথবা বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধানকারী হাকিম সুপারিশ করলে আমলে গ্রহণকারী হাকিমের ওই আসামিকে বাদ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা থাকবে না।

(ওএস/এসপি/জুন ০৪, ২০১৮)