রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি : নওগাঁর রাণীনগরে সরকারি খাস পুকুর দখল করাকে কেন্দ্র করে আ’লীগ নেতা আজিম উদ্দিনকে হত্যার ৯ দিন পার হলেও হত্যার মূল পরিকল্পনাকারি সাবেক ইউপি সদস্য সুবাশ সরকার বাবলুসহ বাঁকি আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আসামিদের মধ্যে অনেকেই প্রকাশ্যে বীর দর্পে এলাকায় ঘোরাফেরা চলাফেরা করলেও আসামিদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ এমন অভিযোগ করেন নিহতের পরিবার ও গ্রামবাসী।

হত্যা ও মামলার জড়িত আসামিদের গ্রেফতার করতে না পারায় পুলিশের ভূমিকা ও ন্যায় বিচার না পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে পুলিশ দাবি করেছে, আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে আদালতের নিশেধাক্কা থাকার কারনে ওই পুকুরটি বর্তমানে কাউকে বা কোন সমিতিকে লীজ দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

হত্যা মামলায় ২৮ জনের নাম উল্লেখ ও আরো অজ্ঞাত ১২-১৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করার পর দুই দিনে মাত্র ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাণীনগরে প্রায় সাড়ে ২২শ’ টি সরকারি পুকুর রয়েছে। এই পুকুর নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকে একটি প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দখলের উৎসব করে আসছিল। এই দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় মারপিট, মামলা, বাড়ি-ঘর ভাংচুর করা হয়েছে।

স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, উপজেলার প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে কালীগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক সদস্য ও গৌড়দিঘী গ্রামের সুবাশ সরকার বাবলুর নেতৃত্বে ১২-১৩ বছর আগে পুকুর দখলের এ সিন্ডিকেটে গড়ে উঠে। এই সিন্ডিকেটের উপজেলার পূর্বাঞ্চলের সরকারি পুকুরগুলো জবর দখল ও পুকুরের মাছ লুটপাট করে আসছিল।

উপজেলার করজগ্রাম সখিনপাড়ায় মসজিদ সংলগ্ন সরকারি একটি খাস পুকুর মসজিদ কমিটি ও গ্রামবাসী মসজিদের উন্নয়নে ভোগ দখল করে আসছিলেন। ওই খাস পুকুরটি মসজিদ কমিটির কাছ থেকে লীজ নিয়ে প্রায় ১৪-১৫ বছর থেকে মাছ চাষ করে আসছিলেন নিহত আজিম উদ্দিনের ভাই মো: শহিদুল ইসলাম। পুকুরটি নিয়ে আদালতে মামলাও রয়েছে। এমত অবস্থায় গত দুই মাস আগে ওই সিন্ডিকেটে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে পুকুরটি লোহাচুড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লীজ পায় বলে প্রচার প্রচারণা চালায় ওই সিন্ডিকেট পাটি।

এরপর পুকুরটি দখল করতে বাবলুর নেতৃত্বে গত ১৫ জুন থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত রাণীনগর উপজেলা শহর ও বেলঘড়িয়া বাজারে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে রাণীনগর বাজার এলাকার বালুভরা, রাজাপুর, লোহাচুড়া, বেলঘড়িয়া, সিংগারপাড়া গ্রামের একাধিক সন্ত্রাসী দখলবাজ উপস্থিত ছিল।

বাবলুর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হঠাৎ করে ২৭ মে রবিবার দুপুরে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত সাহাদত হোসেন সায়েম, নাজমুল হক মাসুম, আব্দুল আজিজ, রহিমসহ ৩৫-৩৫ জন মোটরসাইকেল যোগে ওই পুকুরে মাছ ছাড়তে যান। এমত অবস্থায় আজিম উদ্দিন ও গ্রামবাসিদের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সায়েম ও তার দলবল লাঠিসোটা, লোহার রড, হাতুড়ী ইত্যাদি দিয়ে এলোড়িপাতি দিয়ে মারপিট শুরু করে। তাদের মারপিটে শহিদুল ইসলাম, তার বড় ভাই আজিম উদ্দিনসহ জালাল ও তাদের মা মানিকজান বেওয়াসহ ৭-৮ জন গুরুত্বর আহত হন।

আহতদের মধ্যে উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি আজিম উদ্দিনের অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় তাকে বগুড়া উপজেলার আদমদিঘী হাসপাতালে ভর্তি করনো হয়। অবস্থা বেশী আশঙ্কাজনক হলে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। নওগাঁ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আজিম উদ্দনকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় ২৮ মে সোমবার নিহতের ভাই আলিম উদ্দিন বাদী হয়ে সায়েমকে প্রধান আসামী করে ২৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় আরো অজ্ঞাত আসামি রয়েছেন ১২-১৩ জন।

মামলার পর দুই দিনে ৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হত্যার পর থেকে পুকুর দখল ও হত্যার মূল পরিকল্পনাকারি বাবলুসহ অনেকেই পলাতক রয়েছেন।

ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারি অভিযুক্ত সাবেক ইউপি সদস্য সুবাশ সরকার বাবলু পলাতক থাকায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মামলার বাদী নিহতের ভাই আলিম উদ্দিন জানান, ওই পুকুরটি মসজিদ থেকে লীজ নিয়ে তারা মাছ চাষ করছিলেন। পুকুরে প্রায় ২০-২২ লাখ টাকার মাছ ছিল। মাছ লুট করা ও পুকুর দখলের জন্যেই এলাকার ওই চক্র দীর্ঘ দিন থেকে পাঁয়তারা চালাচ্ছিল। তারই অংশ হিসেবে ওই দিন পুকুর দখল করতে আসে তার। এ সময় তার ভাইসহ গ্রামবাসি বাধা দিলে আজিম উদ্দিনকে হাতুড়ি-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, হত্যার ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে অনেকেই এলাকায় বীর দর্পে ঘুরলেও আসামীদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ। এতে হত্যার ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পুলিশের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে আজিম উদ্দিন হত্যা ও এর সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান নিহতের মা মানিকজান বেওয়া।

রাণীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএসএম সিদ্দিকুর রহমান জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রধান সায়েমসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার আসামিরা পলাতক থাকায় গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি অপর প্রশ্নে আরো বলেন, ঘটনায় ইত্যে মধ্যে অনেকের নাম এসেছে সত্যতা যাচাই করে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া বিনতে তাবিব জানান, আদালতের নিশেধাক্কা থাকার কারনে ওই পুকুরটি বর্তমানে কাউকে বা কোন সমিতিকে লীজ দেয়া হয়নি।

(এসকেপি/এসপি/জুন ০৪, ২০১৮)