কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি : দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি এমপিকে তারই ফুফাতো ভাই আলম আহমেদ হত্যা করবে বলে হুমকি দিয়েছে এমন অভিযোগে কাপাসিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়রী করা হয়েছে। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান প্রধান বাদী হয়ে কৃষকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মোতাহার হোসেন মোল্লা, আলম সরকারসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে এ জিডি করেন।

কাপাসিয়া থানার জিডি নম্বর ৭৯, তারিখ ২ জুন বলে জানা গেছে। আর এতে মামাতো ফুফাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিরোধ যেন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও কৃষকলীগের বিবাদমান দু’টি পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, সাংবাদিক সম্মেলনে পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য, থানায় অভিযোগ দায়ের, সভা সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারী, হামলা, পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন, ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটছে। অপরদিকে কৃষক লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম বাবলু বাদি হয়ে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৭১ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কাপাসিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।

থানার সাধারণ ডায়রী সূত্রে জানা যায়, গত ১ জুন বিকালে কাপাসিয়ার দক্ষিণগাঁও এলাকার আলম সরকার নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়। কাপাসিয়ার এমপি সিমিন হোসেন রিমিকে হত্যা করে ফেলবে ও তার ঢাকার বাসায় গিয়ে পিটিয়ে কতল করে ফেলবে এবং কাপাসিয়া থেকে এমপি রিমিকে বিতারিত করবে। ঈদের পর এমপি রিমিকে ও রিমির সঙ্গে থাকা আওয়ামীলীগের লোকজনকে সময় সুযোগমতো খুন জখম করবে বলে হুমকি দেয়।

জিডিতে কৃষকলীগের উপদেষ্টা আলম সরকার (৫৩), কেন্দ্রীয় কৃষকলীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা (৬২), উপজেলা কৃষকলীগের সভাপতি আইন উদ্দিন (৬৫), সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম বাবলু (৫০), যুগ্ম সম্পাদক হাফিজুল হক চৌধুরী আইয়ুব (৪৫), কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সদস্য জানে আলম কনকসহ (৪৫) অজ্ঞাতনামা আরো ৮-১০ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে।

তাজউদ্দীন কন্যা সিমিন হোসেন রিমি এমপি গত শনিবার বিকালে সরকারী ডাকবাংলোতে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আমার মধ্যে কোনো সম্পর্কের অবনতি হয়নি। কেউ তা কখনো করতেও পারবে না। একটি চক্র কাপাসিয়াকে অশান্ত করতে ও কাপাসিয়ায় লুটের রাজ্য কায়েম করতে উঠে পড়ে লেগেছে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন পরিবারের মাঝ খানে এসে কেউ দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারবে না।

অপরদিকে কৃষক লীগের উপদেষ্টা আলম সরকার অভিযোগ করে বলেন, কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, জাতীয় শোক দিবস, ৭ মার্চসহ কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে না। আমরা কৃষকলীগের মাধ্যমে গত কয়েক মাস যাবত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম প্রচারে সভা-সমাবেশের আয়োজন করছি। তিনি আরও বলেন, আমরা এ ধরনের প্রচার সভা করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি।

গত ১৯ এপ্রিল কড়িহাতায় এমনই এক ‘সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রচার’ সভার পাশে পাল্টা কর্মসূচি দেয় ছাত্রলীগ। পরে স্থানীয় প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে। গত ৩১ মে বারিষাবতে উন্নয়নমূলক প্রচার সভা ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে মঞ্চ, ৩টি মাইক্রোবাস ভাঙচুর করে এবং ইফতার ছিনিয়ে নেয় ও তছনছ করে।

জানা যায়, ২০১৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটি গঠন করা হয়। নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১ ভোটে অ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খানকে পরাজিত করে সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে উপজেলার অনেক প্রবীণ ও ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ কমিটি গঠনের পর থেকে আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় উপজেলা আওয়ামীলীগ থেকে অ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খান, সম্মেলনে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান আরিফ, টোক ও সিংহশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যানসহ ডজন খানেক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদিত জেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে অ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খানকে সহ-সভাপতি মনোনীত করা হয়।

এছাড়া বহিষ্কৃত অনেককে জেলা ও কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত করা হয়। দল ক্ষমতায় থাকার পরেও অনেক নেতাকর্মীর নামে থানায় মামলা হয়। নানা বিষয় নিয়ে কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সাথে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। অনেক প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাকর্মী নিষক্রিয় হয়ে পড়েন।

এ অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদের ভাগিনা ও শিল্পপতি আলম সরকারকে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়। মোতাহার হোসেন মোল্যার নেতৃত্বে কৃষকলীগ উপজেলা আলাদা কর্মসূচি পালন শুরু করে। এরই মধ্যে আলম সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসাবে নিজের নাম ঘোষণা করেন। গত ১ জুন শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে আলম আহমেদ অভিযোগ করেন, এ বিষয়ে কৃষকলীগের পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। পরে শুক্রবার বিকালে আওয়ামীলীগের পক্ষে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্্ পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে হামলায় দলীয় নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন এবং কৃষকলীগের বিরুদ্ধে সংগঠন বিরোধী কাজ করার অভিযোগ আনেন।

পরদিন ২ জুন শনিবার স্থানীয় সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় ও ইফতার করেন। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে তার নির্বাচনী এলাকায় কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা ও উপদেষ্টা আলম সরকার তার বিরুদ্ধে দলীয় কর্মসূচির নামে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন।

তিনি কৃষকলীগের উপদেষ্টা আলম সরকারের নাম উল্লেখ করে বলেন, সে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তিনি হত্যার হুমকিসহ সকল ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কঠোর শাস্তিমূলক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।

পরে শনিবার রাতেই কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান প্রধান বাদী হয়ে কাপাসিয়া থানায় একটি জিডি করেন (জিডি নং ৭৯)। থানায় লিপিবদ্ধ জিডিতে অভিযোগ করা হয়, বিবাদীরা ভাড়া করা সন্ত্রাসী এনে কর্মীসভা করে স্থানীয় এমপি সিমিন হোসেন রিমির বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক, আপত্তিকর, কুরুচিপূর্ণ, মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন। সংসদ সদস্যকে কাপাসিয়া থেকে বিতাড়িত করার, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ার এবং জীবন নাশের হুমকি দিয়েছে। বিবাদীরা স্থানীয় রাজনীতিকে কুলষিত করছে বলে অভিযোগ করেন।

এদিকে পাল্টাপাল্টি জিডি, মামলা ও সাংবাদিক সম্মেলনের ঘটনায় উভয় পক্ষের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

(এসকেডি/এসপি/জুন ০৫, ২০১৮)