অনুবাদ : দিলারা রিঙকি

[১৯৩৯ সালের ১৩ এপ্রিল উত্তর আয়ারল্যান্ডের চৈমনিয়ারনের এক কৃষিজীবী পরিবারে সিমাস হিনি’র জন্ম; তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কেবল সূচনা। তার বাবা প্যাট্রিক হিনি একজন কৃষক এবং গবাদিপশুর ব্যবসায়ী, মা মার্গারেট ক্যাথলিন ম্যাককান ছিলেন গ্রামীণ আয়ারল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের মেয়ে। নয় ভাই-বোনের মধ্যে হিনি জ্যৈষ্ঠতম। শৈশবে গ্রামের অন্যান্য সাধারণ বালকের মতো তিনি বেড়ে ওঠেন। ১২ বছর বয়সেSt. Columb’s College এ স্কলারশিপ পেয়ে ল্যাটিন ও আইরিশ ভাষা শেখেন। এরপর কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে এসে টেড হিউজের কবিতার সাথে তার পরিচয় এবং তারই প্রভাবে কবিতায় পদচারণা। কবি হিসেবে প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ১৯৬০ সালে। সে সময়ের সক্রিয় কবিদের মধ্যে রচনার কৌশল ও প্রকৃতিগতভাবে হিনি ভিন্ন ধারার একজন কবি। তার কবিতার পটভূমি ও বিষয়বস্তু হিসেবে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাণকথা বিরাট জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। কবিতার প্রতি নিবেদিত হিনি মনে করেন- শিল্পের এক ধরনের শক্তি আছে, মানুষকে তা বদলে দিতে পারে। ১৯৬১-তে প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক পাশ করেন। চাকরি জীবন শুরু করেন স্কুল শিক্ষক হিসেবে, পরে বারো বছর চাকরি করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ের কবিতার অধ্যাপক। স্ত্রী মারিয়া ডেভলিন তার কবিজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। আইরিশ কবিদের মধ্যে হিনি দ্বিতীয় নোবেল বিজয়ী কবি। ১৯৯৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু নোবেল সম্পর্কে তার ভাষ্য, ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিরাপদ ভূমিধসে আটকে পড়ার মতো’। সমালোচকদের মতে তিনি হলেন সর্বশেষ গীতি কবি। দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগে ৩০ আগস্ট ২০১৩ সালে চুয়াত্তর বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার কবিতার বই মোট ১৩টি, বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-Death of a Naturalist (১৯৬৬),Door into the Dark (১৯৬৯),Wintering outWintering out (১৯৭২),North (১৯৭৫),Station Island (১৯৮৪),Human Chain (২০১০)।]

দুধ কারখানা

পাইপের ভেতর ঘুরপাক খেয়ে ফণা তুলছে ছোট ছোট
শাদা শাদা ঢেউ। আমাদের ইতস্তত হাঁটাহাঁটির পাশেই
সবলে প্রবেশ করছে, ছুঁটছে এদিক থেকে ওদিকে
ছলকে পড়ছে নিজে নিজেই, আর এভাবেই নতুন মোড়কে
তৈরি হচ্ছে কৌটো বন্দি দুধ। আর বদলি শ্রমিকের দল
পালাক্রমে অতিক্রম করছে বৃত্তাকার সময়, তারা
গাভির উজ্জ্বল বাটের মতো সযত্নে রেখেছে কারখানাটিকে।

যতোটা গভীরে যাই আমরা আরো স্থির, বিস্মিত বিহ্বল,
বাছুরের সজল চোখ জ্বলজ্বল করছে এখানে সেখানে।


অনুসরণকারী

ঘোড়া দিয়ে লাঙল টেনে
মাঠে মাঠে হালচাষ করেছে আমার বাবা,
তার কাঁধ ভূ-গোলকের মতো,
হাতের পেশি মাটিতে ফলার গভীর দাগ কেটে
টেনে ধরেছে ঘোড়াদের রাশ।
আর টানটান আবেশে
অতিশয় সতর্ক হয়েছে ঘোড়াগুলো।

উজ্জ্বল চামড়ার চাবুক দিয়ে বাবা
আঘাত করেছে ঘোড়াদের পিঠে।
সাথে বৃষ্টির তেজ
ঘাস ও শিকড়যুক্ত মাটিতে
গড়িয়ে চলেছে বিরামহীন।

হাড়ভাঙা খাটুনির পর
একটিমাত্র বিন্দুতেই মিলেছে
আয়ত চোখদুটি তার
লাঙলের ফলার রেখাগুলো যেখানে
শস্যের মানচিত্র এঁকেছে নির্ভুল।

আজও আমি হোঁচট খেলেই
বাবার ভারি জুতোর প্রতিধ্বনি পাই।
মাঝে মাঝে উজ্জ্বল তৃণলতায় ভূপতিত হই।
মাঝে মাঝে বাবা আমাকে তার পিছু পিছু
এগিয়ে নিয়ে চলে
পরিশ্রান্ত অবিরাম বন্ধুর পথ।

আমি তো চেয়েছি
বাবার সাথে চাষাবাদে মন দিতে।
আমি তো চেয়েছি
তার চোখের মণি হতে।
সবসময় আমি তাকে অনুসরণই করেছি
আমার খামারের চারপাশে
পেয়েছি তার প্রশস্ত ছায়া।
আমি বারবার ভুল করেছি
বাবা আমাকে শুধরে দিয়েছে,
হোঁচট খেয়ে অপ্রত্যাশিত পড়ে যাওয়া থেকে
বাঁচিয়েছে আমাকে
বারবার।
কিন্তু আজ আমি ধূলিস্মাৎ হলেও
দূরে সরে থাকে বাবা।

স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ

হ্রদের জল নেমে যায়
অরণ্যকে বিস্ময় বিমূঢ় করে
দাঁড়টানা হাতলের পুরনো কাঠের লাঠি
বছরের পর বছর
আঁশের বিন্যাস হাতলটিকে আরো মজবুত করেছে,
আত্মাগুলো কারারুদ্ধ

গাছের রস ও ঋতুর শাসনে।
অগভীর জলের ছোট ছোট ঢেউয়ের
আছড়ে পড়া শব্দের বিনিময়
বিশ্বস্ত পুণ্যস্নান,
যেন জলমগ্ন ভালোবাসার
বিন্দু বিন্দু আঘাতে

গুহার তলদেশে মূর্ছিত চুনাপাথর।
মৃত লাভা,
শীতল নক্ষত্র,
জ্বলন্ত কয়লা আর হীরা
অথবা আগুনদাহ
উল্কার হঠাৎ জন্ম

আর এটাই স্বাভাবিক,
যা মায়াহীন ধ্বংসাবশেষের সঞ্চয়
স্কুলের তাকে সাজানো,
রঙিন যবের মতো
একটুকরো পাথর।


কবিতাকণ্ঠ

গ্রীষ্মের শেষ দিকে, মধ্যরাতেও
রোদের গন্ধ আমাকে ঘুমোতে দেয় না।
বাতাসের ঘাটতি পূরণে
জানালার কাছে এসে দাঁড়াই
দেখি ক্লাব থেকে বেরিয়ে যায় একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক।

ওদের কণ্ঠস্বর ঝাপটা বাতাসে ঘণ হয়ে
আঘাত করলেও আমি যন্ত্রণামুক্ত থাকি।
ক্লাবটি যেন তেল-জলে বুদ্বুদ সোনালি কার্প তার পিচ্ছিল
নরম শরীর। একসময় ‘ডক্টর ফিশ’ নামে ডাকা হতো বলে
মিঠে জলের মাছেরা এখানে ক্ষত সারাতে আসে।

শাদা পোশাকে একটি মেয়ে
প্রণয় প্রার্থনা নিয়ে বসে আছে গাড়িতে
তার হাসিতে যৌবনের বাঁধভাঙা জোয়ার
আমি অনুভব করছি পুরনো পাইক মাছের আভিজাত্য, কিন্তু
ওই শান্ত, সারশূন্য জীবনে আপাতত আমি সাঁতার কাটতে চাচ্ছি না।

ওরাকল

বটগাছের গহ্বরে লুকিয়েছে কোকিল
অথচ মাঠের পর মাঠ ছড়িয়ে পড়ছে
তার ডাকাডাকি।
তুমি কী শুনতে পাচ্ছো
সে ডাকছে তোমাকে।
প্রাচীন গাছটির কাছে এসে
শেকড়ে পা রাখো,
আরো কাছাকাছি
তার অভিগমনে
নিজেকে নিরাকার করে ভাবো
সে তোমাকে বাইরে ডাকছে।
সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে গেছে
তার কানের লতি আর স্বরযন্ত্র।
তুমি ওই শরীরের সাথে নিবিষ্ট হও।
ছোট ছোট কণ্ঠে কথা হবে
কোকিলের সাথে।