মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : সবই তো শ্যাষ দ্যাহেন। আমরা এ্যাহন আছি এই কয়ডা পরিবার। ঝড়, বৃষ্টি হইলেই বালুর ঢিবি চাঙ্গইল (ফাঁটল) লইয়া পইড়্যা যায়। সাগরের জোয়ারের ঢেউয়ের তোড়ে ঘর, দুয়ার (দড়জা) কাঁপে। জানি না এই বইষ্যায় (বর্ষা) আর টেকতে পারমু কিনা। কহন যে সাগরে সব ভাসাইয়া লইয়া যায় এই চিন্তাই করি। 

এ কথা বলতে বলতে চোখে,মুখে এক উৎকন্ঠা ফুঁটে উঠে এক সন্তানের জননী রাবেয়া বেগমের (২২)। ২৬ মাস বয়সী শিশু সন্তান তানজিলাকে বুকে আঁকড়ে ধরে সাগরের দিকে ভয়াল দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। তারপর বলেন, চিন্তা কইর‌্যা আর কি হইবে। আগেও তো ঐ সাগরে তিনবার ঘর ভাসাইয়া নেছে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে কয়েকশ গজ পশ্চিমে “কুয়াকাটা আদর্শ গ্রাম”। এই আদর্শ গ্রামটি এখন সাগর গর্ভে বিলীন হওয়ার আশংকার এ গৃহবধু রাবেয়ার মতো শতাধিক ছিন্নমূল জেলে পরিবার এখন চরম আতংকে রয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯৮-৯৯ সালে কুয়াকাটা সৈকতের মূল সড়কের পশ্চিম দিকে ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়ের জন্য তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ২০০ পরিবারের জন্য গুচ্ছগ্রাম তৈরি করে। সেখানে আশ্রয় নেয় অন্তত আড়াই হাজার মানুষ। জেলে, হকার, শ্রমজীবি, স্বামী পরিত্যক্তা ও অসহায় মানুষকে পূনর্বাসনের জন্য সরকার ওই সময় এ আদর্শগ্রাম তৈরি করে। কিন্তু আদর্শ গ্রাম তৈরি করলেও সাগরের ভাঙ্গন থেকে গ্রামটি রক্ষায় কোন উদ্যেগ না নেয়ায় ২০০৫-০৬ সালে সাগরের ভাঙ্গনে গ্রামটি ভাঙ্গতে শুরু করে। ২০০৭ সালের সিডরে লন্ডভন্ড হয়ে যায় গোটা গ্রামটি। ওই সময় এ গ্রামের বহু পরিবারকে পূনর্বাসন করে সরকার। কিন্তু এখনও আদর্শ গ্রামের বালুর মৃত্যুকূপে এখনও বাস করছে শতাধিক পরিবার।

কুয়াকাটা পৌরসভার দুই নং ওয়ার্ডে অবস্থিত এ আদর্শ গ্রামে ভোটার সংখ্যা প্রায় দুইশ। কিন্তু নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এ পৌরএলাকা শুধুই ভাঙ্গন আতংকেই না, রয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিদেশন সুবিধার অভাব। নির্বাচন হওয়ার আগে জনপ্রতিনিধিরা অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেই এখন এই দূর্ভোগের সময় কেউ তাঁদের খবর নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন এ আদর্শ গ্রামের বাসিন্দারা।

জেলে বাবুল পাহোলান। এই গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু সাগরের ভাঙ্গনে সে এখন গৃহহারা। তিনি বলেন, গত বছর এক রাইতে হঠাৎ সাগরে পানি বাইড়্যা যাওয়ায় বড় বড় চাঙ্গল লইয়া বালুর ঢিবি ভাইঙ্গা পড়ছে। সাগরের জোয়ারের ঢেউ বালুর ঢিবিতে আঁচড়ে পইড়্যা ঘরের মধ্যে পানির ছিটা গ্যাছে। হারা রাইত এই হানের সবাই ভয়ে বাইরে রাইত কাডাইছি। পরদিন দেহি ঘরের খুটির গোড়ার বালিই ধুইয়া নেছে। ওইদিনই এলাকা ছাড়ছি সব কিছু লইয়া।

আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা জেলে মো. সোহেল মিয়া (৪৫) বলেন, গত ছয়-সাত বছরে কতো ঘরে যে সাগরে ভাইস্যা গেছে হেইয়ার কোন হিসাব নাই। অমাবইশ্যা-পূর্নিমা হইলেইতো ভাঙ্গে এই গ্রাম। বালুর ঢিবির উপরে ঘর। সাগরে পানি বাড়লেই বালি ধুইয়া নামে। কোন প্রটেকশন নাই।

সদ্য বিয়ে করা জেলে শহিদুল(২৪) এই বালুর ঢিবিতে কোনরকম একটি ঝুপড়ি করলেও তার আশকা কখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব কিছু। সাগরে যখন মাছ শিকার করেন,তখন স্ত্রী একা থাকে। ঝড়,জলোচ্ছাস হলে তখন কে তাকে রক্ষা করবে এই চিন্তায় সে এখন উদ্বিগ্ন।

ষাটোর্ধ আব্দুল আজিজ মাঝি বলেন, চাইর-পাঁচবার ঘর ভাঙ্গছে আবার সরাইয়া অন্যত্র ঘর তুলছি। প্রতিবার ঘর তুলতে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সাগরে মাছ ধইর‌্যা আর কয় টাকা পাই। এইবার তাই ভয়তে ঘর ভাঙ্গার আগেই সরাইয়া নিছি।

এ আদর্শ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, সাগরের জোয়ারের জ্বলোচ্ছাসে গত কয়েক বছরে ইউনুছ মাঝির তিন বার, বকুলন্নেছা, বাবুল পাহোলান, মনির হোসেন, জহিরুল ইসলাম, মনির মিয়া, আব্বাস, বাবুল হোসেন, এসমাইল, কাওসার, মোশারেফ হোসেনের দুই-তিন বার ঘর ভেঙ্গে গেছে।

গতবছর জলোচ্ছাসে এ গ্রামের মনির মিয়া, মনির মাঝি, জহিরুল, ইসমাইল, আব্বাস, আজিজ মাঝি, আলামিন, নাসির, মো. মনিরুল ইসলামসহ অন্তত ৫০ টি ঝুপড়ি ঘর সাগরে ভেসে গেছে। এই পরিবারগুলো এখন কুয়াকাটা সৈকতের বেড়িবাঁধের বাইরে এবং মাঝিবাড়ি বাঁধের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে।

‘সাগর এইদিকে ভাঙ্গে, আর আমরাও পিছনে যাই। জন্মের পর হইতে পাঁচবার ঘর সাগরে ভাঙ্গছে। বিয়ার পর ভাবছি স্বামীর ঘরে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকতে পারমু। কিন্তু এ্যাহন দেহি সাগরের ভাঙ্গতে আর দেরি নাই এই ঘরডাও। এ্যাহন কই যামু হেই চিন্তায় আছি। মোগো তো আর জায়গা জমি নাই।’ এই কথাগুলো বলেন তিন সন্তানের জননী মাহমুদা বেগম। তিনি বলেন, রাইতে ঘুম হয় না। বালি ধুইয়া ধুইয়া পইর‌্যা যাইতাছে। আর কয়দিন থাকতে পারমু এই হানে জানি না।

স্থানীয়রা জানায়, পূর্নিমা ও অমাবশ্যা’র জো’সহ সাগরের প্রতিটি জোয়ারে ধ্বসে পড়ছে বালুর ঢিবি। এ বালুর ঢিবি ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন হুমকির মুখে পড়েছে কুয়াকাটার মূল রক্ষা বাঁধ। ইতিমধ্যে বহু স্থাপনা সাগরের ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে।

কুয়াকাটা পৌর কাউন্সিলর শাহালম হাওলাদার বলেন, সাগরের তীর ঘেষে হওয়ায় আদর্শগ্রামটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। বেড়িবাঁধের বাইরে এই আদর্শগ্রাম হওয়ায় তারা উন্নয়ন বঞ্চিত। কুয়াকাটা উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় বেড়িবাঁধের বাইরের এসব পরিবারকে অন্যত্র পূনর্বাসন করা হবে।

কুয়াকাটা পৌরসভার সচিব হুমায়ুন কবির জানান, আদর্শ গ্রামটি সাগরের ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার কারনে ওই গ্রামে স্থায়ী উন্নয়ন কর্মকান্ড হচ্ছে না। ইতিমধ্যে অনেক পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিশুদ্ধপানি, স্যানিটেশন সুৃবিধাসহ সবধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড পর্যাক্রমে সম্পাদন করা হবে।

(এমকেআর/এসপি/জুন ১০, ২০১৮)