রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য তিন লাখ টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া এক লাখ ঘুষের টাকাসহ সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের গোপনীয় বিভাগের টাইপিষ্টকে হাতে নাতে গ্রেফতার করেছে দুদক। মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের নিজ অফিস ঘর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতের নাম একেএম শাহীদুজ্জামান টুটুল (৩৮)। তিনি সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানাধীন পারকুমিরা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোহরাব হোসেনের ছেলে।

দূর্ণীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ড. আবুল হাসান জানান, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দেবনগর বেগম রোকেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কল্পে তিন লাখ টাকা অনুদান পাওয়ার জন্য ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেদী হাসান গত বছরের ৩০ জুলাই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন। ওই দিন তা রিসিভ করেন প্রতিষ্ঠানটির গোপন শাখার টাইপিষ্ট একেএম শাহীদুজ্জামান টুটুল। টাকা পেতে হলে ৩০ শতাংশ টাকা অগ্রিম ঘুষ দিতে হবে বলে ওই প্রধান শিক্ষককে জানান শাহীদুজ্জামান। সে অনুযায়ি প্রধান শিক্ষক তাকে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা দেন।

পরবর্তীতে তিনি দু’ লাখ টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। বাকী টাকার জন্য শাহীদুজ্জামান ওই প্রধান শিক্ষককে নানাভাবে ঘোরাতে থাকেন। গত ৩১ মে প্রধান শিক্ষক দেখা করলে শাহীদুজ্জামান তাকে ঘুষের টাকা দ্রুত দিতে বলেন। বিষয়টি তিনি গত ৩ জুন তার(দুদক পরিচালক) বরাবর এক আবেদন করে প্রতিকার দাবি করেন। সে অনুযায়ি তারা ফাঁদ প্রস্তুত করে মেহেদী হাসানের কাছ থেকে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা (২৩৬১২০১ থেকে ২৩৬১২৫০) ইনভেনটরী তালিকা প্রস্তুত করে তা মেহেদী হাসানকে অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘুষ প্রদানের জন্য পাঠিয়ে দেন।

তিনি আরো জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে তার নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক নাজমুল হোসাইন সহকারি পরিচালক মহাতাবউদ্দিন, উপসহকারি পরিচালক মোশররফ হোসেনসহ একটি টিম সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকেন। মেহেদী হাসান ৫০ হাজার টাকা নিয়ে শাহীদুজ্জামানকে দিতে গেলে তিনি আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। এ সময় ওই শিক্ষকের পক্ষে ধুলিহরের হাসান হাদী তাকে আরো ৫০ হাজার টাকা দিলে তিনি এক লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করে নিজের জিন্সের ডান পকেটে রাখেন। টাকা নেওয়ার সংকেত পেয়েই শাহীদুজ্জামানকে হাতে নাতে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে শাহীজ্জামানকে গ্রেফতারে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে দাবি করে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের নেৃতৃত্বে ১৮ জন সদস্য ও কয়েকজক কর্মকর্তা- কর্মচারি মঙ্গলবার দুপুর দু’ টোর দিকে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন জেলা পরিষদের প্যানেল মেয়র আমিনুল ইসলাম বাবু । বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ নজরুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয় ১৯৯০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে একটানা ২৭ বছর চাকুরির সুবাদে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে এসএম মাহাবুবর রহমান রাম রাজত্ব কায়েম করেছেন।

নিজের ছেলে মেহেদী হাসান, ভগ্নিপতি খায়রুল ইসলাম, ভাই হুরাইরাসহ সাতজনকে সেখানে চাকুরি করে দিয়েছেন। দূর্ণীতির মাধ্যমে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। প্রতিবাদ করায় অনেকেই তার বলির পাঠা হয়েছেন। বর্তমানে তার অনিয়ম ও দূর্ণীতির প্রতিবাদ করায় অফিসের অনেকেই তার শত্রু হিসেবে পরিণত হন।

সম্প্রতি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কক্সবাজারে পিকনিকে যাওয়ার সময় একটি দূর্ণীতি করলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য অবমাননাকর বলে মাহাবুবর রহমানকে সতর্ক করা হলে তিনি নিজে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণা দেন। একপর্যায়ে বিকেলে ইস্তফাপত্র দিয়ে রাতে কৌশলে তা প্রত্যাহার করে নিয়ে ছুটির আবেদনপত্র জমা দেন। এরপর তিনি ছুটিতে থাকাকালিন রাতে অফিসে এসে নৈশপ্রহরীর মাধ্যমে দরজার হ্যাজবোল্ড ভেঙে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে দূর্ণীতির তদন্ত শুরু হলে তিনি নিয়ম বহির্ভুতভাবে এক বছরের ছুটির আবেদন করে ছুটির দিন রাতে নৈশ প্রহরীকে দিয়ে দরজা খুলতে বাধ্য করে নিজের ফাইলপত্র সংশোধনের কাজ করে আসছিলেন।

সম্প্রতি তা জানতে পেরে তার কক্ষের দরজায় নতুন তালা লাগিয়ে দিয়ে তার নামীয় সাইনবোর্ড সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে মাহাবুবর রহমান তার বিরোধিতাকারি সহকর্মী ও কর্মচারিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এমনকি তিনি অফিসে না থাকলে ছেলেসহ স্বজনদের দিয়ে তাদেরকে একে একে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে টাকা না পাওয়ার পরও গোপনীয় শাখার টাইপিষ্ট শাহীদুজ্জামানকে এক লাখ টাকাসহ দুদুকের হাতে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। দুদক গ্রেফতারের আগে বা পরে পরিষদ চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে পুলিশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে শাহীদুজ্জামানকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে। এটা যথাযথ হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে শাহীদুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি, দুদক ও পুলিশকে কলুষিত করতে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্দ্ধতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। নইলে আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়।

এদিকে সংবাদ সম্মেলনকালে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী শাহ্ আব্দুস সাদীর গাড়ি চালক ফিরোজ হোসেন জানান, দুদকের উপসহাকারি পরিচালক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এমসএম মাহাবুবর রহমানের খুব নিকট সম্পর্কের কারণে তাদের গাড়িতে করে ওই দুদক কর্মকর্তাকে খুলনায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এ সময় ল্যাপটপ, মাছ, টাকাসহ বিভিন্ন উপহারন সামগ্রী দেওয়া হয়। মাহাবুবর রহমানের বিরুদ্ধে দূর্ণীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে চার বছর যাবৎ তিনি এ সব কাজ করে আসছেন।

জানতে চাইলে শাহীদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি গত পহেলা জুন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত চিত্তবিনোদনের ছুটিতে রয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে এসএম মাহাবুবর রহমানের ছেলে মেহেদী হাসান ও ভগ্নিপতি খায়রুল ইসলাম তাকে মোবাইল ফোনে অফিসে আসার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর তাকে পরিকল্পিতভাবে ঘুষ কেলেঙ্কারীতে ফাঁসানো হয়েছে।

তবে ছুটিতে থাকা সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুবর রহমান জানান, যথাযথভাবে ওঁৎ পেতে শাহীদুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছে দুদক। বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তাকে ও তার স্বজনদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। তদন্তে বাস্তব সত্য বেরিয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদী।

সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মারুফ আহম্মেদ জানান, ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতারের ঘটনায় দুদকের খুলনা বিভাগীয় সহকারি পরিচালক মহাতাবউদ্দিন বাদি হয়ে শাহীদুজ্জামানের নাম উল্লেখ করে ১৯৪৭ সালের দূর্ণতি প্রতিরোধ আইন এর ৫(২) ধারায় মঙ্গলবার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। গ্রেফতারকৃতকে মঙ্গলবার বিকেলে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

(আরকে/এসপি/জুন ১২, ২০১৮)