প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

কিন্তু ঠিকই এক সময় স্রোতের টানে আমিও ছাত্ররাজনীতির খপ্পরে পড়ে গেলাম। হাইস্কুলের পরিবেশই আলাদা। নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব জুটতে লাগলো। বেশ আনন্দের সঙ্গেই প্রতিদিন স্কুলে যাই। মাঝেমাঝে মিছিল এলে পরে স্কুল ছুটি হয়ে যায়। মিছিলে যাই। শ্লোগান দিই। মুজিববাদী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দাপট সর্বত্র। এভাবে ধীরে ধীরে শহর প্রদক্ষিণ করতে করতে বেশ চেনাজানা হয়ে গেল অনেক অলিগলি আমার ও দীপুর। আমরা একটি অবিচ্ছিন্ন জুটি ছিলাম আশৈশব। অনেক আকাম-কুকামের সাক্ষী পরস্পর। মেয়েদের সৌন্দর্যের দিকেও দৃষ্টি ধাবিত হতে শুরু করেছে তখন। পাড়ার হেনা, মিলু, আভা, খুকু কিংবা আহাম্মদ আলী দারোগার মেয়ে দিলশাদকে দেখে কেমন যেন সলাজ-সুমধুর অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। বিশ্রী বেপরোয়া ভাবও জাগে মাঝেমধ্যে। দমনও করি। তখন যৌনতা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা পাপ করার শামিল ছিল শৈশবমনে। তারপরও পাপ জাতীয় কাজ করিনি তা নয় ধরা পড়ে বাবা-মা, অন্যান্য অভিভাবকদের মৃদু তিরস্কার শুনেছি। আবার অনেক সময় তারাও আমল দেয়নি। এবং এক সময় সবাই সেটা ভুলেও গেছি। এসব মনে রাখার ঘটনা নয় চলমান মানবজীবনে। যখন মিছিলের সঙ্গে রাজগঞ্জ, ছাটিপট্টি, চকবাজার পর্যন্ত গেয়েছি তখন শিখার মুখ মনে পড়েছে। এখানেই তো ডিগম্বরিতলা। এখানেই ওদের বাসা।

মনটা ভারি চঞ্চল হয়ে উঠতো। মাকে যে বলবো নিয়ে যেতে তাও বলতে পারি না মুখ ফুটে কী এক অব্যক্ত লজ্জায়। এভাবে এক বছর চলে গেল। আমি অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম। বাবা প্রতিদিন খুব সকালে ডেকে তুলে আমাকে ইংরেজিটা পড়ায়। বলে, ‘ভালো করে না পড়লে ভবিষ্যৎ নেই। বেকার হয়ে ঘুরতে হবে। ম্যাট্রিকটা ভালোভাবে পাশ করো।’ মা বললো বাবাকে, ‘পটু বড় হচ্ছে বাসাটাও ছোট। সরকারি কলোনীতে তো পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে একটি কোয়ার্টার পাওয়ার কথা। কোয়ার্টারগুলো দেখতে খুব সুন্দর। বিদ্যুৎ বাতি আছে। জলও আছে। পরিবেশও সুন্দর। দেখেন না চেষ্টা করে!’ বাবা প্রথমে আমলে নেয়নি। বললো, ‘আরও কিছুদিন পর।’ কিন্তু মার জোরাজুরিতে চেষ্টা করলো যদিও খালি পাওয়া গেল না। তবে খালি হলে পাওয়া যাবে এমন আশ্বাস মিললো। মা লেগে রইলো কবে কোন্ কোয়ার্টারটা খালি হয়। আহাম্মদ আলী দারোগার স্ত্রীও লেগে গেলেন। এক বছরে বেশ কয়েকটি কোয়ার্টার খালি হলেও বাবা একটিও পেলো না। কি কারণ? উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে প্রচুর ঘুষ দিতে হয়। অত টাকা বাবার নেই। মা শুনে হাল ছাড়লো না।

সুরেশবাবু নামে এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের স্ত্রীর সঙ্গে আহাম্মদ আলী দারোগার স্ত্রীর ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। খালাম্মা মাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওই ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীর সঙ্গে। মা ভদ্রমহিলার সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুললো। তাছাড়া ওই ভদ্রলোকের একটি মামলাও ছিল কোর্টে। সব মিলিয়ে মা তাঁকে ধরে অনেক দেন দরবার করে একটি কোয়ার্টার হস্তগত করলো। তিন তলা। আমরা উঠলাম সে বাসায়। কিন্তু এক বছরের মাথায় পেছনে শত্তুর লেগে গেল। কারণ দেখানো হলো, এসআই হিসেবে বাবা এই সরকারি কোয়ার্টার পেতে পারে না। এগুলো গেজেটেড অফিসারদের জন্য। অথচ লোয়ার র‌্যাঙ্কের সরকারি অফিসার একাধিক আছে দিব্যি বছরের পর বছর ধরে এই কলোনীতে! মূল ঘটনা সেখানে নয়, সুরেশবাবু জানালেন যে, এই কলোনীতে হিন্দু কেউ নেই। হিন্দুদের দেয়া হয় না। তাছাড়া অধিকাংশ কোয়ার্টারেই আছে মুসলিম লীগার, ফেনাটিকরা। বাবা মাকে বললো, ‘দেশ আর দেশ নেই। এই স্বাধীনতা আমাদের জন্য নয়।

আমরা ভুল স্বাধীনতা পেয়েছি। এই স্বাধীনতা এখন শিখিয়ে দিচ্ছে এই লোকটা হিন্দু, এই লোকটা মুসলমান, এই লোকটা খ্রিস্টান, বৌদ্ধ! এই তফাৎ আরও সম্প্রসারিত হবে অদূর ভবিষ্যতে। অধঃপতন শুরু হয়েছে ভালো করেই একেবারে তৃণমূল থেকে। চলো ছেড়ে দিই এই কলোনী। ভাবছি পার্টনারশিপে ব্যবসা করবো। কয়েকটি অফার আছে। তাতে করে কিছু না কিছু বাড়তি ইনকাম হবে। ভালো বাসা নেবো একটা।’ একদিন বাসা ছাড়ার নির্দেশও এসে গেল। কী অপমান! মা খুব দুঃখ পেলো এই ঘটনায়। সযত্নে, সুন্দর করে সংসারটি সাজিয়েছিল মা। আমিও কয়েকজন নতুন বন্ধু পেয়েছিলাম। যখন নবম শ্রেণীতে উঠলাম বাবা কলোনীর বাসা ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে উঠলো ধর্মসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে পরিচিত এক আইনজীবী গোলাম মোর্তুজা চৌধুরীর দোতলা বাড়ি ‘নূরমহলে’র নিচতলায়। পুরনো দালান।

স্যাঁতস্যাঁতে ঘরগুলো যদিওবা মেঝে পাকা। বারান্দা আছে তবে উঠোনের সঙ্গে সমান্তরাল। কিন্তু বিদ্যুৎ আছে এ বাসায়। শুধু এই বাসাতেই নয় সবার বাসাতেই। বাসার সামনে দিয়ে চলে গেছে পৌরসভার রাস্তা। সড়ক ও জনপথ অফিস, স্টাফ কলোনী, একাধিক ইঞ্জিনিয়ার, আনসার অ্যাডজুটেন্ট, চট্টগ্রাম বিভাগীয় জেলার, ব্যবসায়ী, প্রফেসর, চা-বাগানের ম্যানেজার, আইনজীবী, ডিসির পিএস, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারসহ বহু এলিট ও ভদ্রলোকের বাসাবাড়ি এ পাড়াতে আছে। জেলাবোর্ড অফিসের রাস্তা গিয়ে মিশেছে বাদুরতলার রাস্তা পর্যন্ত। এখানেই মোড়ে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি। মোটকথা দারুণ ভদ্রপাড়া। রান্নাঘরসহ চার রুম এই বাসাটির। বাথরুম ও টয়লেট একসঙ্গে, কিন্তু অন্ধকার। বাসার দুদিকেই দুটি ছোট্ট পুুকুর। বৃষ্টি হলেই পুকুর উপচে জল এসে যায় উঠোনে। পেছনের দিকে কয়েক ঘর পরিবার।

সামনে আহাম্মদ আলী নামে বাবারই বন্ধু প্রাক্তন এক মুহুরির একতলা বাসা। বহুপ্রাচীন ভবন। তার লাগোয়া বাসাটিও প্রাচীন এবং দোতলা ইট-চুন-সুড়কির পাঁজর বেরিয়ে পড়া। মালিক বাবার পরিচিত এক ডিবি অফিসার, ভূপেশ রায়সরকার। এই বাড়ির পরেই আমিনুর রহমান অ্যাডভোকেটের বাড়ি, মুসলিম লীগার হলেও বাবার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং উদারমনের মানুষ তিনি। তাঁর বাসার সম্মুখটাই একটি চৌরাস্তার মোড়। উত্তর দক্ষিণ বরাবর জেলাবোর্ড রোড, পশ্চিম দিকে পৌরসভা, পুলিশ লাইন রোড, জেলখানা রোড, আর পূর্বদিকে সরু একটি উঁচু পথ মিশেছে ধর্মসাগর দীঘির পাড়স্থ উদ্যানের প্রবেশপথে। এখানেও উত্তর-পশ্চিম বরাবর রাস্তা আছে পার্ক রোড নামে। পরবর্তীকালে কালেক্টরেট ভবন তৈরি হলে পরে অনেকে কালেক্টরেট ভবনরোডও বলে। বহু বছর ধরেই পরিত্যক্ত। এই রাস্তাটিও আবার দক্ষিণ দিকে গিয়ে বাদুরতলার চৌরাস্তার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। ধর্মসাগর পার্ক তথা একমাত্র পৌর উদ্যানের কারণেই চমৎকার পরিবেশ। বাবার অফিসও মাত্র কয়েক মিনিটের পথ বাসা থেকে। বাবা এই পার্করোডই ব্যবহার করে।

‘নূরমহল’ পুরনো দালান বলে ভাড়াও বেশি নয়। দোতলায় থাকেন কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড অফিসের একজন কর্মকর্তা, নিঃসন্তান আবদুল মালেক। শিশুপ্রিয় এই দম্পতি আমাদেরকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন। খুবই স্মার্ট এবং সুদর্শন ছিলেন মালেক সাহেব। মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। তিনি ছিলেন পাড়ার ছেলেমেয়েদের কমন মালেকমামা হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। মামীও ছিলেন মাটির গড়া মানুষ। বিয়ের অনেক বছর পর তাঁদের সন্তান এসেছিল অবশ্য নিজে গাঙচরে বাড়ি করার পর নতুন বাড়িতে। বড় হয়েও মাঝেমাঝে আড্ডা দিতে যেতাম মানিক, বিষ্ণু, স্বপন ও আমি। ‘স’এর সঙ্গে বেশ কয়েকবার মামার বাসায় ডেট করেছি। মামা-মামী জানতেন ভালো করে আমাদের সম্পর্কের কথা। সম্ভবত এঁদের মাধ্যমেই বাবা-মার কানে পৌঁছে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্কের খবর বলে আমরা ধারণা।

এ পাড়ায় আসার পর নতুন বন্ধু পেলাম অসংখ্য এবং কয়েক মাসের মধ্যে পাশের ঝাউতলা, খ্রিস্টান পাড়াতেও বন্ধু জুটে গেল। সমবয়সী বন্ধু ছাড়াও বড়ভাইদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে সময় নিল না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে স্বপন সেনগুপ্ত, বিষ্ণু সাহা ছিল কুমিল্লা হাই স্কুলেরই ছাত্র। নতুন করে এ পাড়ায় পরিচয় হলো। একইসঙ্গে স্কুলে যেতাম। এরপর ছিল গোলাম মোর্শেদ মানিক (অকাল প্রয়াত), শঙ্করকুমার সাহা, মঞ্জুর আহমেদ পাটোয়ারী, শাহীন আহমেদ, শফিকুল বার চৌধুরী দুলাল ও মুশফিকুল বার চৌধুরী হেলাল দুভাই, কাউসার আহমেদ চৌধুরী, মঞ্জুর মোর্শেদ, মানিকের ছোটভাই মামুনুর রশীদ, সজল রায়সরকার (অকাল প্রয়াত), মাহেআলম কাজল, মোত্তাকিম কিসলু, জুয়েল প্রমুখ আর মেয়েদের মধ্যে নাসরীন জাহান, নায়লা, শাহীনের বোন শিরীন, সোহেলী, শুল্কা রায়সরকার, কিসলুর বোন মীনা, রীনা, আনিস ভাইয়ের বোন বাপ্পি, হ্যাপ্পি, স্বপনের বোন বেবী, বিষ্ণুর বোন দীপ্তি প্রমুখ।

বড়ভাইদের মধ্যে শতদল রায়সরকার ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড়, গোলাম ফারুক (মানিকের বড়ভাই), মনা পাটোয়ারী (মঞ্জুর বড় ভাই), জুয়েলভাই (দুলাল ও হেলালের বড়ভাই), বিমলদা (স্বপনের বড়দা), জাহিদভাই, মোমিনভাই, শ্যামল রায়সরকার (শতদল, শুল্কার মেজদা), বাকীভাই (বামপন্থী ছাত্রনেতা), কাফিভাই, আনিসভাই (খেলাঘর কর্মী), তাপস রায়, মনির ভাই (বর্তমানে জাপান প্রবাসী), লাভলুভাই (কিসলুর বড়ভাই), শাজাহানভাই, বাবুলভাই (মঞ্জুর মোর্শেদের বড় ভাই) প্রমুখ। বড়ভাইদের নাম এ জন্য নেয়া যে তাঁদের সঙ্গে ছিল অকাট্য টক-ঝাল-মিষ্টি সম্পর্ক আমার। এঁদের সাহায্য, সহযোগিতা ও উৎসাহ আমাকে লেখক হতে সাহায্য করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি এপাড়াসহ ঝাউতলা, খ্রিস্টান পাড়ার বন্ধু-বান্ধব ও বড়ভাইদের কাছে আলাদা একটি স্থান করে নিয়েছিলাম মূলত সদাচরণ ও নিজস্ব লাইফ স্টাইলের কারণে। আর একটি জিনিস খুব ভালো লাগতো তা হলো: বন্ধু ও বড়ভাই নির্বিশেষে সকলেই বাবাকে খুব সমীহ করতো। স্বল্পবাক, বিনম্র এবং ভালো কাজে উৎসাহী বাবার ইমেজটা এপাড়ার সকলকেই দারুণ আকৃষ্ট করেছিল। এই জন্য আমার গর্ববোধ হতো।

যদিওবা বাবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো আমাদের খুবই কম---তবুও রাস্তাঘাটে যখনই ছোট-বড় কারো সঙ্গে দেখা হতো এক মিনিট দাঁড়িয়ে কুশলাদি বিনিময় করাটা ছিল বাবার স্বভাব এটা অনেক অভিভাবকের মধ্যেই ছিল না। বরং আমাদেরকে তাঁরা অবজ্ঞাই করতেন। নানা রকম সমালোচনা করতেন, ধমক-ধামকি দিতেন। কিন্তু বাবা উঠতি ছেলেদের দুষ্টুমি, দস্যিপন্য ইত্যাদি কখনোই আমল দিত না। বলতো, ‘এসব এই বয়সের অহঙ্কার, তা না হলে আর তরুণ কেন?’ বাবা তাঁর অন্যান্য বন্ধু ও অভিভাবকদের বোঝাতে চেষ্টা করতো। তবে রাজনীতির বিষয়ে বাবার ভীষণ অনীহা বা এলার্জি ছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও সমাজসেবামূলক কাজে বেশি উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারে বাবার কোনো ঘাটতি ছিল না, পড়ালেখার ব্যাপারেও খুব জোরজারি দেখাতো না। বরং উৎসাহ দিত যে কাউকেই। ...চলব।

আলোকচিত্র : বামে, আমার সময়ে যে পৌরউদ্যান ছিল এখন একেবারেই বিশ্রী এবং জঙ্গলে পরিপূর্ণ। ডানে, ভাষাশহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, আমাদের সময় চমৎকার একটি বাংলো ধাঁচের বাড়ি ছিল।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ১২, ২০১৪)