রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : মাদক ভাগাভাগি নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের আনিছুরের পরিবারের সদস্যরা ভাল নেই। পরিবারর একমাত্র আয়ক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে তাদের। স্থানীয় দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ঈদের জন্য ১০ কেজি চাল দেওয়া হয়। তবে নিহতের মা,দু’ সন্তান ও স্ত্রীর জন্য জোটেনি কোন নতুন কাপড়। বৃদ্ধা মা দোকানে দোকানে যেয়েও বাকীতে পাননি এক টুকরা মাংস। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার হুমকিতে রাতে বাড়িতে ঘুমোতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। নিজ পেশায় বাইরে কাজ করতে গেলে নতুন করে মামলায় জড়ানো হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন তারা।

রবিবার সকালে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা পাকুড়িয়া গ্রামের বাড়িতে গেলে এসব কথা তুলে ধরেন নিহত আনিছুরের পরিবারের সদস্যরা। কথা বলার একপর্যায়ে তারা জানালেন, ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘আনিছুর তো মরেছে, তোমাদের পরিস্থিতি ও তার মত হতে পারে। সংবাদ সস্মেলন করে সাংবাদিকরা তোমাদের বাঁচাতে পারবে না। টেলিভিশনে দেখেছো না এক সাংবাদিককে ধরে পুলিশ পাছায় মোমবাতি দিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে দিয়েছে!’ বাঁচতে চাও তো পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তুলে নাও।’ নইলে তোমাদের জোর করে তুলে নিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করানো হবে।

আনিছুরের স্ত্রী নাজমা খাতুন বলেন, এক সময় রাঙামাটি থেকে তক্ষক সাপ কিনে এনে বিক্রি করার ফলে তাদের সংসার ভাল চলতো। কোন রকমে তারা পাকা বাড়িও করেছেন। তবে রান্না ঘর,পায়খানা ও বাথরুম বানাতে আশা এনজিও থেকে ৫০ হাজার ও গ্রামীন ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সে ঋণের কিস্তি কিভাবে শোধ করবেন তা তিনি জানেন না। একমাত্র ছেলে রিয়াজুলকে ছলিমপুর কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হলেও তার বাবার মৃত্যুতে আর পড়াশুনা হয়ে উঠবে না। অষ্টম শ্রেণীতে পড়–য়া মেয়ে রিমার পরিণতি হবে একই। এখন দু’ সন্তানকে কচুশাক জোগাড় করে দিতে পারলেও আগামিতে ভাত ও জুটবে না। ইচ্ছা থাকলেও পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভয়ে তাদেরকে কেউ সহযোগিতার হাত বাড়াতে সাহস পাচ্ছে না। তার স্বামী ইতিপূর্বে মাদক সেবন করতো এমনটি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, সে কখনো মাদক ব্যবসা করতো না। কয়েকটি পরিকল্পিত মামলায় তাকে আসামী করা হয়।

আনিছুরের বিধবা বোন রাশিদা খাতুন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার গুলিবিদ্ধ লাশের বিভীষিকা তুলে ধরে বলেন, এমন করে মানুষ মারা হয় সেটা ভাবতেই কষ্ট হয়। এরপরও সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল থেকে লাশ আনার জন্য জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য কোন ব্যক্তির সহযোগিতা পাননি তারা। অবশেষে ভাই অজিহার বরিশাল থেকে ফিরে লাশ এনে দাফনের ব্যবস্থা করেছে। পরিবার প্রধানকে মেরে ফেলায় একটি সংসার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে।

আনিছুরের বৃদ্ধ মা মাফিয়া বেগম বলেন, বয়সের প্রথম ঈদ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেন তারা। মুখে এতটুকু সিমাই ও ওঠেনি। যারা খোকাকে মেরে ফেলার পরও হুমকি দিচ্ছে তাদের আল্লা বিচার করবে। ছেলে অজিহার যাতে ঠিকমত ব্যবসা করতে পারে সেজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সংসার চালানোর জন্য আনিছুরের ছেলে বা স্ত্রীর জন্য একটি কাজ দেওয়ারও অনুরোধ করেন তিনি।

তবে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা সকালে চলে গেলেও খবর পেয়ে রোববার দুপুর পৌনে একটার দিকে তাদের বাড়িতে ছুঁটে যান খোরদো ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই সিরাজুল ইসলাম। তিনি আনিছুরের ভাই অজিহারের কাছে জানতে চার কারা , কোথা থেকে ও কেন এসেছিল। কি জানতে চেয়েছিল। তাদের কোন নাম বা মোবাইল নম্বর আছে কিনা। তারা আসলে কেন তাকে মোবাইলে জানানো হয়নি ?

দুপুর একটার দিকে একইভাবে দেয়াড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান তাদের কাছে একই ভাবে সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মীদের সম্পর্কে জানতে চান।

প্রসঙ্গত, কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের আনিছুর রহমানকে গত ২৮ মে সকাল ৯টার দিকে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় খোরদো পুলিশ ফাঁড়ির সহকারি উপপরিদর্শক এজাজ মাহমুদ ও সহকারি উপপরিদর্শক তারিকুল ইসলামসহ চারজন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার নাথ জিডি না নেওয়া ও প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে পারেননি। ২৯ মে সকালে তারা জানতে পারেন ওই দিন দিবাগত গভীর রাতে কলারোয়ার পিছলাপোলে ‘মাদক ভাগাভাগি’ নিয়ে দুই গ্র“পের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলিবিদ্ধ হয়ে আনিছুর রহমান নিহত হয়েছেন। পুলিশের এমন সাজানো ঘটনার ১১ দিন পর ৮ জুন দুপুরে ছেলে রিয়াজুল, মেয়ে রিমা, বড়ভাসুর অজিয়ার রহমান ও স্ত্রী ফরিদা খাতুনকে নিয়ে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সস্মেলন করেন আনিছুরের স্ত্রী নাজমা খাতুন।

সংবাদ সম্মেলনে আনিছুরকে বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। সংবাদ সম্মেলন শেষে বাড়িতে গেলে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান ও দেয়াড়া ইউপি সদস্য আলমগীর হোসেন তাকে সংবাদ সম্মেলনের নিউজ বন্ধ করার জন্য বলেন। পরে খোরদো পুলিশ ফাঁড়ির সহকারি উপপরিদর্শক এজাজ মাহমুদ ও সহকারি উপপরিদর্শক তারিকুল ইসলামসহ কয়েকজন পুলিশ বাড়িতে আসে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আত্মগোপন করে আনিছুরের ছেলে ও স্ত্রী। পুলিশ এসেই ইয়াবা আছে বলে ঘর তল্লাশি করবে বলে হুমকি দেয়। আনিছুরের স্ত্রীকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে আনিছুরের মেয়ে রিমা এজাজ মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বলে , আপনিই তো আমার বাবাকে প্রকাশ্য দিবালোকে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান দলবল নিয়ে এসে সংবাদ সম্মেলনের প্রতিবাদ জানাতে বলেন। একইভাবে ৯ জুন সকালেও আব্দুল মান্নান একটি কাগজে প্রতিবাদ লিখে তাতে সই দিতে বলেন। যদিও পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের কাছে নিহতের পরিবারের সদস্যদের কোন প্রকার হুমকি ধামকির কথা অস্বীকার করেন।

(আরকে/এসপি/জুন ২৫, ২০১৮)