স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশ নজীরবিহীন স্বল্প সময়ে সাভারের আশুলিয়ার সেই ‘ভ্যানচালক নয়ন হত্যা’ রহস্য উন্মোচন করতে এবং হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া একজন খুনিকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছে। 

সোমবার সকাল দশটায় সাভারে ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানা গেছে গ্রেফতারকৃত খুনী মোঃ ছগীর (৩০) বরগুনা জেলার বেতাগী থানার বেতমোড় গ্রামের মোঃ আব্দুল জলিলের পুত্র। বর্তমানে সে সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানাধীন কুরগাও এর জনৈক মোস্তফার বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছিলো।

উল্লেখ্য, ৯ জুন (শুক্রবার) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে স্মৃতিসৌধের পিছনের সামীনা প্রাচীরের কচু ক্ষেত থেকে ভ্যান চালক নয়নের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতের মাথায় ধারালো অস্ত্রের জখমের চিহৃ ছিলো এবং তাঁর মাথা কচুক্ষেতের কাদা মাটির মধ্যে চাপা দেয়া অবস্থায় পাওয়া যায়।

চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের হাতে মামলাটি ন্যস্ত হলে, এখানের অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদের দক্ষ নেতৃত্বে এবং সুনিপূণ অপরাধ বিশ্লেষণ এবং পরিকল্পনার দ্বারা খুবই অল্প সময়ে এই হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হবার পাশাপাশি খুনিদের একজনকে গ্রেফতার করাও সম্ভবপর হয়েছে। এই মামলাটি তদন্তে দক্ষ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সমন্বয়ে ‘টোটাল টিম-ওয়ার্কের’ দ্বারা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি অপরাধ মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ পূর্বক কাজ করা হয়েছে। এ এফ এম সায়েদের নির্দেশনায় ঢাকা জেলা (উত্তর) অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আবুল বাশার এবং উপ-পরিদর্শক জামিরুল ইসলাম নিজেদের মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে খুনী মোঃ ছগীর জানায়, সে আব্দুল্লাহপুর টু নবীনগর রুটে গ্রামীন মিনি বাসের গাড়ির চালক। তাস খেলা নিয়ে গন্ডগোলের কারণেই নয়নকে হত্যা করে তারা। নিহত নয়ন তাদের বন্ধু ছিলো। ৮ জুন (শুক্রবার) রাতে সে এবং নিহত নয়ন, কালাম, লাবু, সোহাগ এবং আনিস সহ এই ছয়জন স্মৃতিসৌধের ভিতরে জুয়া খেলতে বসে। খেলায় ৩ হাজার টাকার মতো জিতে যায় ভ্যান চালক নয়ন। আর এতে করে বাকীরা যারা সবাই ইয়াবার নেশায় আসক্ত ছিলো, ব্যাপারটি মেনে নিতে না পারায় ওখানেই নয়নকে ইট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরের নানা জায়গায় আঘাত করে । এক পর্যায়ে নয়নের মাথায় ইটের আঘাতের পর আঘাত দ্বারা ওর মৃত্যু নিশ্চিত করে স্মৃতিসৌধের দক্ষিণ পাশের বাউন্ডারি ওয়ালের ১০ ফুট ভিতরে কচুক্ষেতের ভিতরে ফেলে রেখে যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক জামিরুল ইসলাম বলেন, নিহত নয়নের মোবাইল সেটটি হত্যাকারীরা হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নিজেদের সাথে নিয়ে যায়। এজন্য আমরা আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে ৩০ জুন সন্ধ্যার সময় নিহত নয়নের মোবাইল সেটটি আশুলিয়া থানাধীন বুড়ির বাজার থেকে এই মামলার সাক্ষী জনৈক মোঃ মইনুল গাজীর নিকট থেকে উদ্ধার করি। জিজ্ঞাসাবাদে মইনুল গাজী জানায়, তার ওস্তাদ মোঃ পরাণ মোল্লা সহ নবীনগরে ভবঘুরের মতো ঘোরাফেরাকারী ধৃত আসামী মোঃ ছগীরের নিকট থেকে মোবাইল সেটটি ক্রয় করেছে। এর জের ধরে অভিযান পরিচালনা করে নবীনগর থেকে ১ জুলাই (শনিবার) দিবাগত রাত আনুমানিক ৪টা ৩০ মিনিটের সময় আসামী মোঃ ছগীরকে গ্রেফতার করে আমাদের হেফাজতে নেই।

তিনি আরও জানান, ইন্সপেক্টর আবুল বাশার পিপিএম সহ আমরা আসামীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে ঘটনা খুলে বলে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়ে সম্মত হয়। তখন জানা যায় মাত্র সাড়ে চারশো’ টাকায় আলিফ গাড়ির হেল্পারের কাছে আসামী মোঃ ছগীর নিহত নয়নের মোবাইল সেটটি বিক্রী করেছিলো। আর এই মোবাইল সেটের সূত্র ধরেই এই হত্যাকাণ্ডটির জট খুলতে পারা গেছে এবং এত দ্রুত খুনিকে ধরা সম্ভব হয়েছে।

তিনি বলেন, অনেক সময় চালাক খুনিরা নিহতের মোবাইল ফেলে যায় কিংবা সিমটি ও নষ্ট করে ফেলে। তখন যে স্থানে খুন হয় সেই এলাকায় ঐ সময়ে কোন কোন সিম এক্টিভ ছিলো সেগুলির তালিকা সংগ্রহ করে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে হয়। প্রয়োজনে কল লিস্ট এবং ভয়েস কলও সংগ্রহ করা হয়। আমরাও এভাবে তদন্ত কাজটি করেছিলাম।

উপ-পরিদর্শককে খুনের আসল কারণ কি ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে খুন হইছে এবং যারা করেছে, এরা সকলেই ছিলো নেশাগ্রস্ত। এদের কেউ ইয়াবা খায়, কেউ গাঁজা খায়। ২ জুলাই (রবিবার) আসামী ছগীর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। সেখানে সে বলেছে, নয়ন ছিলো তার বন্ধু। দেখা গেছে, তারা এক সাথে যদি ২টা ইয়াবা বড়ি কিনতো, ৬০০ টাকার ভিতরে হয়তো নয়ন ২০০ টাকা দিতো। আবার কখনও ছগীর কম দিতো। এভাবে একটা সম্পর্ক ছিলো ওদের ভিতর। ৮ তারিখে ৬ জন রাতে জুয়া খেলতে বসলে নয়ন একা ৩ হাজার টাকা জিতে গেলে বাকী ৫ জনের ভিতরে আক্রোশের সৃষ্টি হয় এবং তখনই তারা সবাই মিলে ওর কাছ থেকে টাকা কেড়ে নিতে গেলে নয়ন বাঁধা দেয় এবং তখন উত্তেজিত বাকীরা ইট দিয়ে ওকে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।

উল্লেখ্য, নিহত ভ্যানচালক নয়ন মিয়া যশোরের ঝিকরগাছা থানার গনি মিয়ার ছেলে। সে আশুলিয়ার কুরগাঁও এলাকায় ভ্যান চালাতো এবং পরিবারসহ এখানেই বসবাস করতো। নয়নের মায়ের বরাত দিয়ে জানা গেছে, ৮ জুন রাত দুইটার দিকে হঠাৎ কাজের কথা বলে নয়ন মিয়া ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর থেকে আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিলো না। পরে ৯ জুন সকালে লোক মুখে শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে এসে ছেলের ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ দেখতে পান তিনি।

(টি/এসপি/জুলাই ০৩, ২০১৮)