শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : ভাষা সৈনিক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক ড. হালিমা খাতুন আর নেই। আজ মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ( ইন্না ......... রাজিউন)।

তিঁনি হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, রক্তদূষণের মতো নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮৬ বছর বয়সী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় সূচিত হয়েছিলো বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। সেদিন যাদের সাহসী পদক্ষেপ এনে দিয়েছে আমাদের মায়ের ভাষা, দেখিয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন তাদেরই একজন ছিলেন অধ্যাপক ড. হালিমা খাতুন।

তাঁর নাতনী অন্তরা বিনতে আরিফ প্রপা জানান, গত বৃহস্পতিবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে শনিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আজ তিনি মারা যান। হালিমা খাতুনের একমাত্র মেয়ে দেশের অন্যতম আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী। এই ভাষা সৈনিকের মৃত্যুতে সারাদেশের ন্যায় তাঁর জন্মস্থান বাগেরহাটেও বিরাজ করছে শোকাতুর পরিবেশ।

অধ্যাপক ড. হালিমা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৫শে আগস্ট বাগেরহাট জেলা সদরের বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে। বাবা মৌলবী ও কোরআনে হাফেজ শেখ আবদুর রহিম ও মা দৌলতুন নেসা। বাবা ছিলেন তৎকালীন গুরু ট্রেনিং স্কুলের বর্তমান প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং স্কুল (পিটিআই) এর শিক্ষক। নিজে শিক্ষক হওয়ায় তার সাত মেয়ে ও এক ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলতে কোন আপস করেননি তিনি। হালিমা খাতুনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট শহরতলীর বাদেকাড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

এরপর মনমোহিনী গার্লস স্কুল বর্তমানে বাগেরহাট সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন বাগেরহাট প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ বর্তমানে সরকাী পিসি কলেজে । সেখান থেকে ১৯৫১ সালে বিএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে ইংরেজীতে এম এ এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাস করেন। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৩ সালে খুলনা করোনেশন স্কুল এবং আরকে গার্লস কলেজে শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। এরপর কিছুদিন রাজশাহী গার্লস কলেজে অধ্যাপনার পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে কাটে তার জীবনের অধিকাংশ সময়। সেখান থেকে ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। জাতিসংঘের উপদেষ্টা হিসেবে ২ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৭ সালে দুই বছরের জন্য সাভার গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গণবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন দেশের বিশিষ্ট গবেষক ও ভাষা সৈনিক ড. হালিমা খাতুন।

কলেজ জীবনেই রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশজুড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানতে পারেন হালিমা খাতুন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হবেন। ২১ বছর বয়সে ১৯৫১ সালে হালিমা খাতুন ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। সব বিভাগ মিলে সর্বমোট ৪০/৫০ জন ছাত্রী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনকার উইম্যান স্টুডেন্ট রেসিডেন্টটি এখন রোকেয়া হল নামে পরিচিত। এই হলে মোট ৩০ জন ছাত্রী থাকত। তাদের একজন হালিমা খাতুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রোকেয়া খাতুন ও সুফিয়া খানের সঙ্গে হালিমা খাতুন 'হুইসপারির ক্যাম্পেইন'-এ যোগ দেন। তাদের প্রধান কাজ ছিল ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ছিল অনেক নিয়ম-কানুন।

ছাত্রীদের ক্ষেত্রে আরও কড়া নিয়ম। সব সময় কড়া নজরে থাকতে হতো ছাত্রীদের। ৫২'র সেই রক্তাক্ত দিনে সবাই আমতলায় সমবেত হন। ছাত্রীদের দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীদের এই আন্দোলনে শামিল করা। ঢাকার মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে হালিমা খাতুনের ওপর। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য দেয়ার পর পরই শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে ওঠে। 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' শ্লোগান চারপাশে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম বের হয় মেয়েদের দল। তার সদস্য থাকে ৪ জন। জুলেখা, নূরী, সেতারার সঙ্গে ছিলেন হালিমা খাতুনও ছিলেন।

একে একে বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে মেয়েদের ৩টি দল বেরিয়ে আসে। শুরু হয় লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া। সবাই ছুটছে যে যার মতো। তবে সবার লক্ষ্য জগন্নাথ হলের অ্যাসেমব্লির দিকে। হালিমা খাতুনসহ অনেক ভাষা সৈনিক আশ্রয় নেয় ঢাকা মেডিক্যালে। রাস্তায় ভাষা শহীদের তাজা রক্ত। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য সবাই ছুটছে। রক্তে ভেজা রাস্তার মাঝে মানুষের মাথার মগজ ছিটিয়ে পড়া। ছাত্ররা ওই মাথার খুলির ছবি তুলে সেই ছবিটি ছেলেদের হলে রাখে। হলের রুমের দরজা বন্ধ। সেই বন্ধ রুম থেকে ছবিটি আনার দায়িত্ব পড়ে এই ভাষাসৈনিকের ওপর। অন্ধকার রাতে রাবেয়া ও হালিমা জীবনবাজি রেখে পুলিশের সামনে দিয়ে গিয়ে ছবিটি নিয়ে আসে বুকের ভেতর করে।

সেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই মৃত্যু ছিল অবধারিত, তারা দুজন মৃত্যুকে ভয় করেননি। দেশের জন্য,মাতৃভাষার জন্য তারা জীবনবাজি রেখেছেন। ছবিটি আনার পর পরের দিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেই মগজ ছিটানো খুলির ছবি ছাপানো হয়।

আজও আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় সেই ছবিটি দেখতে পাই। ভাষা আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা এবং সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক ভাষা সৈনিক সম্মাননা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কার, বাগেরহাট ফাইন্ডেশনের আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ বিভিন্ন সময় নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। তিনি ছিলেন আমাদের গর্ব। তার সাহস আর অবদান আমাদের চলার পথে প্রেরণা যোগাবে। তার মৃত্যুতে দেশ হারালো এক ভাষা সৈনিক ও শিক্ষাবিদকে। তাঁর জন্মস্তান বাগেরহাটের নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

(এসএকে/এসপি/জুলাই ০৩, ২০১৮)