মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন আমেরিকার অতীব গুরুত্বপূর্ণ দেশ আর্জেন্টিনাতে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন কানাডায় দায়িত্বরত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কামরুল আহসান। কানাডার পাশাপাশি আর্জেন্টিনা, কিউবা, জ্যামাইকা ও ভেনিজুয়েলারও দায়িত্বে আছেন তিনি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে অটোয়াতে হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেন এই পেশাদার কূটনীতিক। ১১ জুলাই শুক্রবার এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে হাইকমিশনার কামরুল আহসান আরো বলেন, মেক্সিকোর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর্জেন্টিনাতে বাংলাদেশ মিশন চালু করা।

দায়িত্ব গ্রহনের পর প্রায় ২ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও হাইকমিশনার কামরুল আহসান বা অন্য কোন কর্মকর্তার সুযোগ হয়নি আর্জেন্টিনা সফর করার। কাগজে-কলমে অটোয়া থেকে দেখা হলেও বাস্তবে রীতিমতো ঝুলে আছে আর্জেন্টিনা-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। দুর্ভাগ্যজনক এই ‘পেন্ডিং’-এর নেপথ্যে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূতীতা ও সিদ্ধান্তহীনতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর সুদূর অটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনকে দায়িত্বমুক্ত করার বিষয়টি একপ্রকার নিশ্চিত হলেও কানাডার পরিবর্তে কোন্ দেশ থেকে আর্জেন্টিনা দেখা হবে এই বিষয়টি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পার হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময়।

হাইকমিশনার কামরুল আহসানের সাথে কথা বলার আগে বৃহষ্পতিবার সেগুনবাগিচাস্থ পররাষ্ট্র দফতরের ‘আমেরিকাস উইং’-এর সাথেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দায়িত্বে থাকা এই উইংয়ের ডিজি মাহফুজুর রহমান এখন ইউরোপিয় দেশ বেলজিয়াম সফরে রয়েছেন অতিরিক্ত সরকারী দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। ডিরেক্টর নূরুল ইসলাম রুমে নেই জানানো হলেও কথা হয় অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি স্বর্ণালী চন্দের সাথে। নবীন এই অফিসার কিছুটা সময় নিয়ে ফাইলপত্র দেখে জানান, অতীতের মতো কানাডা থেকেই আর্জেন্টিনা দেখা হচ্ছে। সেগুনবাগিচার ‘আমেরিকাস উইং’-এর দেয়া তথ্য অটোয়ায় জানানো হলে বিষয়টি বরং ঢাকা থেকেই এক বছর ধরে ‘পেন্ডিং’ রয়েছে বলে আবারো নিশ্চিত করে হাইকমিশন।

এদিকে বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতি সঞ্চারের পাশাপাশি ‘ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি’র কথা বারবার বলা হলেও আর্জেন্টিনার সাথে অত্যন্ত অর্থবহ কূটনৈতিক সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে ঢাকার সিদ্ধান্তহীনতায়। রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের বেশ ক’জন বাংলাদেশি ব্যবসায়ি ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক অযৌক্তিক দীর্ঘসূতীতায়। এই প্রতিবেদকের সাথে নিয়মিত আলাপচারিতায় তারাও হাইকমিশনার কামরুল আহসানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই বলে জানান। তারা বলেন, দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলে আর্জেন্টাইন আইটি ও এগ্রিকালচার সেক্টর এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় পাতাগোনিয়ার বিশাল ফিশিং সেক্টরে বাংলাদেশ থেকে বৈধ জনশক্তি রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি দেশটিতে বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে বাংলাদেশের রফতানি বানিজ্য।

‘এক্সপোর্ট বাস্কেট’ তথা আন্তর্জাতিক রফতানি বানিজ্য সম্প্রসারণ সুনিশ্চিত করতে বুয়েনস আয়ার্সে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে মনে করছেন ঢাকার ব্যবসায়ী মহলও। আর্জেন্টিনাতে বিগ ভলিউমে বেশ কয়েক বছর ধরে সিরামিক সামগ্রী রফতানীকারক প্রতিষ্ঠান ‘ফার সিরামিক্স’-এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মামুনুর রশিদ এই প্রতিবেদককে জানান, ‘‘এমনিতেই ঢাকায় আর্জেন্টাইন দূতাবাস না থাকায় দিল্লী থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রসেসিং করতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব আর্জেন্টিনায় আমাদের দূতাবাস চালু করা এবং এতে করে সহজ হবে ঢাকায়ও আর্জেন্টাইন দূতাবাস আলোর মুখ দেখার বিষয়টি।’’ ফার সিরামিক্সের পাশাপশি শাইনপুকুর ও মুন্নু সিরামিক্সও আর্জেন্টিনায় প্রতিবছর মিলিয়ন ডলারের সিরামিক সামগ্রী রফতানি করে আসছে। নজরকাড়া সিরামিক সামগ্রীই শুধু নয়, বাংলাদেশে তৈরি প্লাস্টিক ও মেলামাইন সামগ্রীর পাশাপাশি আরএমজি তথা গার্মেন্টস সামগ্রীও আশাব্যঞ্জক হারে আসছে আর্জেন্টিনাতে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ৩ বছর আগে তৎকালীণ পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের নেতৃত্বে ঢাকার পররাষ্ট্র, বানিজ্য, কৃষি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আর্জেন্টিনা সহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ সফর করে। উদ্দেশ্য ছিল এতদঞ্চলে বাংলাদেশের বাজার সম্প্রসারণ ও বৈধ জনশক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত করা। পরবর্তিতে ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হলেও গুরুত্ববহ ঐ ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন’-এর ফলোআপ না থাকায় রুদ্ধ হয়ে আছে আজ অপার সম্ভাবনার দেশ আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের দুয়ার। ৩ বছর আগের সফরের সময় বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের সাথে আর্জেন্টাইন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ফলপ্রসু বৈঠক হয়। বুয়েনস আয়ার্সে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে তখন। কিন্তু পরবর্তিতে ঢাকার আন্তরিকতার অভাবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি আজ অবধি। হতাশার মাঝেই তাই আশাবাদ … ঘুম থেকে জেগে উঠবো হয়তো আমরা সহসাই !
(এএস/জুলাই ১৩, ২০১৪)