দীপক চন্দ্র পাল, ধামরাই (ঢাকা) : আগামী ১৪ জুলাই ধামরাইয়ের রথ উৎসব ও তার মাস ব্যাপী মেলা শুরু হবে বাংলার গৌরবময় এই সুপ্রাচীন প্রায় চার শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ধামরাই এর রথ ও রথ মেলা উৎসবের গোড়া পত্তন হয়েছিল বাংলা ১০৭৯ সালে।

“বাংলার বরেণ্য পল্লী কবি জসিম উদ্দিন” তৎকালীন পাক সরকারের আমলে রথ উৎসবে বেড়াতে এসে ওই সময়ের বৃহৎ সুউচ্চ রথে চারিপাশ ও আদি অন্ত দেখে ও পরিদর্শন করে বিখ্যাত এক কবিতা লিখে রথের ইউতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। যার নাম “ধামরাই রথ”। কবি এই কবিতার এক চয়নে লিখেছেন

“ধামরাই রথ.কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্র ধর,
কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।
সুক্ষ হাতের বাটালী ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,
কত পরি আর লতাপাতা ফুল গড়ে ছিল পরিপাটি।
রথের সামনে যুগল অশ্ব।সেই কত কাল হতে
ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।-পল্লী কবি জসিম উদ্দন।

ওই কবিতার চয়নে ফুটিয়ে তুলেন ধামরাই রথের প্রকৃত চিত্র ও ইতিহাস ।এমন অনেক স্মৃতিই রয়েছে এই ধামরাই রথের ইসিহাসে।

আগামী ১৪ জুলাই,ধামরাইয়ের রথ উৎসব।এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও ধর্মীয় রথ উৎসব ও তার মাস ব্যাপী মেলা শুরু হবে। ধামরাই মাধব মন্দির কমিটির উদ্যোগে রথ উৎসব পালনে রথের যাতীয় সংস্কার কাজ ও তার মাসব্যাপী মেলার আয়োজন ও রং তুলির কাজ ইতো মধ্যেই প্রায় শেষের পথে।এই ঐতিহব্যবাহী রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা ধামরাইয়ে এখন সাজ সাজ রব পড়ে গেছে । সংস্কার কর্মীরা জানিয়েছেন রথ উৎসবের আগেই সংস্কার ও রং তুলির কাজ শেষ হবে।

এ উৎসব হিন্দু ধর্মীয় ভাবধারায় প্রায় ৪০০ শত বৎসর পূর্ব হতে শুরু হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারনে এই উৎসব ব্যাপক ভাবে সার্বজনীনতা লাভ করেছে। এই ধর্মীয় রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে ও ইতিহাস খ্যাত ধামরাইয়ে বেড়ানোর জন্য প্রতিটি বাসগৃহে দুরদুরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন এসে ভীড় করে। অতীতে বাংলাদেশ নয় বিদেশ থেকেও হাজারো ভক্তবৃন্দরা রথ উৎসব কে কেন্দ্র করে ধামরাইয়ে এসে ভীড় জমাত। এখনো আসে। পুরো উৎসবটিই কালের বিবর্তনে এখন ধর্মীয় ভাবধারা নয় সার্বজনীন স্রোতধারায় প্রভাবিত হচ্ছে।

এবার ধামরাইয়ে রথ উৎসব উদ্ধোধনী সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ আসন ধামরাইয়ের এমপি এম এ মালেক।

ধামরাই মাধব মন্দির ও রথমেলা উৎসব কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অবঃ) জীবন কানাই দাশ এর সভাপতিত্বে অনুষ্টিত এই রথ অনুষ্ঠানে আরো থাকবেন ধামরাইয়ের বাংলাদেস্থ ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ,ঢাকা জেলা প্রশাসক, ঢাকা পুলিশ সুপার উপস্থিত থাকবেন।

উপ মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধামরাইয়ের এই রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে সাধারন মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। রথ মেলাকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরাও প্রস্তুতি নিয়েছে।

প্রতি বছরের মতো এবারো রথ মেলাকে কেন্দ্র করে মেলাঙ্গন জুড়ে বসছে সহস্রাধিক বিভিন্ন শ্রেণীর ষ্টল। বসবে দেশ খ্যাত সার্কাস দল। পতুর নাচ, মৃত্যু কুপের খেলা নানা ধরনে গ্রামীন খেলা।এসে মেলার বিশেষ আর্কষন বৃহদাকার হাতি।

গ্রাম বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের ধারক ও ইতিহাসের আবর্তে ঘেরা ঢাকার অদুরে ধামরাই উপজেলা এক অতি প্রাচীন ঐতিহ্যময় জনপথ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির এক অপূর্ব ঐতিহ্য রয়েছে এই ধামরাইয়ে। একটি পৌর সভা ১৬টি ইউনিয়নের ৪৩৮টি গ্রাম নিয়ে ধামরাই এর পরিধি বিস্তৃত রয়েছে।

ধামরাই এর চারপাশ ঘেরা বংশী ও কাকিলাজানি নদী বেষ্টিত সবুজের সমাহার ও জনপথ। এক সময় ধামরাই এর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নৌকা ও নৌপথ। পরিবর্তনশীল জগতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সড়ক ও মহাসড়কসহ আধুনিকায়নের ছোয়ায় গড়ে উঠেছে ধামরাই এর পুরো অঞ্চল।

ধামরাই মাধব মন্দির ও রথ মেলা কমিটির যুগ্ম সাধারন সম্পাদক শিক্ষক নন্দ গোপাল সেন বলেন মেলার সব আয়োজন প্রায় শেষ হয়েছে । প্রশাসনিক পূর্ন সহযোগিতা পাচ্ছেন বল্লেন।তিনি বলেন রথ উৎসব সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সকলেই উৎসব সুষ্টু ও সুন্দর ভাবে পালন করবো। মেলায় লাগানো হ্েচ্ছ সিসি ক্যামেরা,শুরু হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার।

রথের দিন সকাল ১০ টায় কায়েতপাড়ার রথখোলায় রথের সামনে ঢাকঢোল, বাদ্য, কাঁসরঘন্টা ও মহিলাদের উলু-উলু ধ্বনিতে মাধব মন্দিরের প্রধান পুরোহিত চপলেশ ও উত্তম গাঙ্গুলি ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন । বিকেল ৪টায় মাধব মন্দির থেকে মাধব বিগ্রহসহ অন্য বিগ্রহ গুলো নিয়ে রথের ওপর মূর্তিগুলো স্থাপন করা হবে ।

এই রথটিমূর্তি সমেত লাখো ভক্ত নর-নারী পাটের রশি ধরে টেনে নিয়ে যাবে পৌর এলাকার গোপনগরে। এখানেই রথটি প্রতিবছরের ন্যায় ৯ দিন অবস্থান করবে.মাধব ও অন্যান্য বিগ্রহগুলি রথ থেকে নামিয়ে নিয়ে ৯ দিন পূজারীদের দ্বারা পুজিত হবে কথিত মাধবের শ্বশুরালয় যাত্রাবাড়ি মন্দিরে। ৯ দিন পর আগামী ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে উল্টো রথযাত্রা উৎসব। পূর্বের ন্যায় মাধব ও তার সহচরদের রথে চড়িয়ে সন্ধ্যায় টেনে আনবে পূর্বের স্থান ধামরাই পৌর এলাকার কায়েতপাড়াস্থ রথখোলায়। এখান থেকে মূর্তি গুলি চলে যাবে পুরোনো মাধবের নিজ আলয় মন্দিরে।

রথ খোলায় রথটি সারা বছর থাকে বলে এই স্থানটির নামকরণ হয়েছে রথ খোলা। এই রথ খোলার ইতিহাসও প্রায় ৪০০ বছরের।১৯৭১ সালে ৯ এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার ও তাদের দোসররা ৭৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৪৪ ফুট পাশে মুল্যবান কাঠের ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় রথ খানা পুড়িয়ে দিয়ে বাংলা ও বাঙালীর উৎসব ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয় বলে জানান কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যান বতে সরকার।

রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে ধামরাই পৌর কায়েতপাড়ার রথখোলা থেকে যাত্রাবাড়ির কথিত মাধবের শ্বশুরালয় পর্যন্ত রয়েছে উৎসবের মেলাঙ্গন। দীর্ঘ এ পথ জুড়ে বসবে হরেক রকমের দোকান। মেলায় দেশখ্যাত সার্কাস দল নাগরদোলা, পুতুল নাচ, মৃত্যুকুপ মোটরসাইকেল, বেদেনীদের চুড়ি, শিশুদের খেলনা, কুটির শিল্পের স্টলসহ বিভিন্ন রকমের সহস্রাধিক স্টল বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে, জানান রথ কমিটির সহসভাপতি জগদীশ সরকার।

ধামরাই থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) রিজাউল হক বলেন,প্রতি বছরের চেয়ে এবার রথমেলা সফল করতে রথ পরিচালনা কমিটির পাশা পাশি পুলিশ,ওয়াচ টাওয়ার, র‌্যাব মোতায়েন করা থাকবে। এছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সাদা পোশাকে এখন থেকেই মেলাঙ্গণে নজরদারি করছেন বলে জানান। তিনি বলেন ইতিমধ্যেই রথ ও মেলা কমিটির নের্তৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়ও করেছেন বলে জানান। শান্তিপুন্য ভাবে এবারের রথ উৎসব সম্পন্ন হবে আশা প্রকাশ করেন।

এ ব্যাপারে ধামরাই রথ কমিটির অন্যতম সদস্য ও শিল্পী সুকান্ত বনিক বলেন- বিগত ২০০৬ সালে ধামরাইয়ের রথ উৎসবে তৎকালীন মাধব মন্দির কমিটির সাধরন সম্পাদক ধামরাইয়ের বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বনিকের আমন্ত্রনে রথ উৎসবে বিশেষ অতিীথ হয়ে আসেন ঐ সময়ের বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাসের দূত শ্রীমতি বিনা সিক্রী।

ধামরাই বাসীর আন্তরিক দাবীর প্রেক্ষিতে শ্রীমতি বিনা সিক্রী তার ভাষনে পূর্বের আদলে ৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক পুড়িয়ে দেওয়া রথটির আদলেই ধামরাইয়ের রথটি নির্মান করে দেবার আশ্বাস দেন।

এরপর রথ ও মাধব মন্দির কমিটির দুই জন কর্মকর্তা বর্তমান প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বণিক ও শিল্পী সুকান্ত বণিক নিজে ধামরাই থেকে ভারতের পুরিতে যান। সেখানেই রথ নির্মান খরচ বিষয়ক তত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনা হয়।

এরপর ভারত সরকার বাংলাদেশের সেতু বন্ধন অটুট রাখতে ধামরাইয়ে রথটির নির্মানে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মানের প্রদক্ষেপ গ্রহন করেন।

এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাসের তত্বাবধানে ২০০৯ সালে ধামরাই রথের টেন্ডার হয়। টেন্ডার পেয়ে উই.ডি.সি.কেল.বিন টেকনো.টাচ -ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের জানুয়ারী থেকে রথ নিমার্ন করেন। ২০১০ সাল থেকেই ধামরাইয়ে পূর্বের আদলে নতুন রথেই উপমহাদেশ খ্যাত ঐতিহাসিক রথ উৎসব চলছে। আর এই রথ উৎসবে প্রতি বছরই বাংলাদেশস্থ ভারতী দুতাবাসের কর্মকর্তবৃন্দরা অংশ গ্রহন করে থাকে।

রথ মেলাকে সফল করার জন্য রথ পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি প্রসাশনের পক্ষ থেকে বহু সংখ্যাক পুলিশ,র‌্যাব, বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা পোষাক ও সাদা পোষাক নজরদারী করবে বলে জানান ধামরাই থানার ওসি শেখ রিজাউল হক দিপু ।তিনি বলে এব্যাপারে শুকবোর বিকেলে রথ কমিটির নের্তৃবৃনদদের নিয়ে থানা মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ মতিবিনিময় সভায় ঢাকার পুলিশ সুপার শাহ্ মিজান শাফিউর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশসুপার(অপরাধ) মোঃ সাইদুর রহমান সহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত

এছাড়াও ইতিহাস খ্যাত রথ উৎসবকে সামনে রেখে ও সফল করার জন্য প্রশাসন এর উদ্্েযাগে উপজেলা মিলনায়তনে নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে আইন শৃঙ্খলা বিষকয় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এমএ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান তমিজ উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান মোহাদ্দেজ হোসেন,মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সোহানা জেসমিন মুক্তা, ধামরাই থানার অফিসার্স ইনচার্জ রিজাউল হক দিপু, স্বাস্থ্যও পঃপঃ কর্মকর্তা ,উইপি চেয়ারম্যান, শ্রী শ্রী যশোমাধাব মন্দির পরিচালানা ও রথ কমিটির প্রচার সম্পাদক সাংবাদিক দীপক চন্দ্র পাল, হিন্দু সম্পদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সহ সরকারী কর্মকর্তা বৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় রথমেলায়,আইন শৃ্খংলা বিষয়ে ও মেলাকে সফল করার জন্য বিস্তারিত আলোচনা হয়।

যশোমাধাব মন্দির পরিচালানা ও রথ কমিটির সাধারন সম্পাদক,কুমুদিনি ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান ও আর পি সাহার নাতি রাজিব প্রসাদ সাহা বলেন, প্রতিবারের মত এবারও রথ উৎসব ও মেলার সার্বিক আয়োজন ষথেষ্ঠ সুষ্টুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। রথ উৎসব ও মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে পৌর এলাকা সহ ধামরাইয়ের একটি পৌর সভা ও ১৬টি ইউনিয়নেই সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। উৎসব মূখর পরিবেশের রূপ লাভ করেছে। আগামী ১৪ জুলাই বিকেল ৪ টায় শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হবে মাস ব্যাপী মেলা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় রথ উৎসব।

তিনি মেলা উৎসবে শান্তি শৃংখলা ও পরিবেশ সুন্দর রাখতে সবার সহযোগীতা কামনা করেছেন এবং রথ মেলা উৎসব উপভোগের করার জন্য আন্তরিকভাবে সকলে কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রথ কমিটি কর্তূক গঠিত স্বেচ্ছাসেবক দলও আইন শূংখলা বাহিনীর পাশপাশি পৌর শহরের পুরো মেলাঙ্গন জুড়ে শান্তি শৃংঙ্খলার কাজে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে বলে জানান।

(ডিসিপি/এসপি/জুলাই ১১, ২০১৮)