প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

এপাড়ায় আসার পর খুব আনন্দে কাটতে লাগলো দিনগুলো। স্কুল থেকে ফিরে এসে ধর্মসাগর দীঘির পাড়ে আড্ডা দেয়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার। প্রচুর লোকজন ও ছেলেমেয়ে বিকেলবেলা বেড়াতে আসতো বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লা থেকে। মাঝেমাঝে পূব পাড়ে স্টেডিয়ামে যেতাম দল বেঁধে খেলা দেখতে। কয়েকজন বন্ধু ও বড়ভাই করতেন কচি-কাঁচার মেলা আর খেলাঘর আসর। যেমন শ্যমলদা ও আনিসভাই নিবেদিতপ্রাণ খেলাঘর কর্মী, কাজল ও তার বড়বোন জুবিলীদি কচি-কাঁচার মেলা। স্বপন, বিষ্ণু ও আমি মাঝেমাঝে যেতাম দুটোতেই তবে সদস্য ছিলাম না।

কচি-কাঁচার মূল সংগঠক মোস্তফাভাই বাবার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘ছেলেমেয়েকে রোববারে পাঠিয়ে দেবেন বাবু।’ আর জুনিয়র আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা আলী ইমাম বলতেন, ‘বাবু, ভাতিজা-ভাতিজিকে খেলাঘরে পাঠিয়ে দেবেন।’ তিনি ছিলেন ছোটরা খেলাঘরের উপদেষ্টা। সেই কারণেই বাবা মাঝেমাঝে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতো, ‘এইসব সংগঠনগুলোতে যেও। পরিবেশ পাবে। নতুন ভালো বন্ধু পাবে। মতবিনিময় করতে পারবে। সিনিয়রদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে যা স্কুলে শেখার সুযোগ নেই।’ আবার এও বলতো, ‘নতুনকে নিয়ে মাতামাতি করা ভালো, তাই বলে পুরনোকে তুচ্ছ ভেবে সরিয়ে রেখো না। নতুন ও পুরনো দুটোই মূল্যবান। যেমন তোমার দুটি চোখ।

তুমি কি মাঝেমাঝে যাও আগে যেখানে আমরা ছিলাম? এখন আমার প্রমোশন হয়েছে, বেতন বেড়েছে, কয়েক জনের ব্যবসায় পুঁজি খাটাচ্ছি সেখান থেকে মাসে মাসে বেশ কিছু টাকা আসছে তাই তো তোমাদের নিয়ে ভদ্রপাড়ায় বাস করতে পারছি। তাই বলে আমি ভুলে যাইনি বিহারিদের রিফিউজি কলোনী, ছোটরার দিনগুলোকে। আমি প্রতিসপ্তাহে সেখানকার লোকদের সঙ্গে কথা বলি। সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টা করি। আমার উত্থান ঘটেছে সেই দরিদ্র, অসহায়, জীর্ণশীর্ণ মানুষদের ভালোবাসার কারণে বলেই সবসময় মনে করি। তাই বলে যে আমি আমার ধনশালী বন্ধুদের অপছন্দ করি তা নয়। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারলে তুমি একসময় একা হয়ে যাবে, আর অগ্রসর হতে পারবে না। তাই বলি, মাঝেমাঝে ওখানে যেও। দীপুর বাবা, তোমার লক্ষ্মীমাসি, সঞ্জুর বাবা, কিশোরের বাবা, খোকার বাবা, আহাম্মদ আলী দারোগা তোমাকে খুব স্নেহ করতো তোমার মনে আছে হয়তো, তারা আমার কাছে তোমার গল্প বলেন। তোমাকে দেখতে চান। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার বাবা। বেড়াতে হলেও যেও।

শিখার বাবা মাঝেমাঝে কোর্টে আসেন তিনি তোমাকে যেতে বলেছেন তাঁদের বাসায়। এখন তো রাস্তাঘাট চেনো। যেও। সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখো। এক সময় এইসব খুব মূল্যবান স্মৃতি ইতিহাস হয়ে তোমাকে কাঁদাবে। আমি জানি সেটা। এটাই মানুষের জীবন। জীবনটাকে ছককাটা ঘর করে সেখানেও ওদেরকে স্থান দিও।’ কী আশ্চর্য! বাবার কথাই আজ জীবনের এই অপরাহ্নে এসে নির্মম সত্যি বলে প্রতিভাত। এসব কথা শোনার পর সত্যি আমি একটু একটু করে জেগে উঠতে লাগলাম। তাই তো! মনে হলো: কত দিন ধরে যেন সঞ্জু, রঞ্জু, মিলন, মফিজ, আভা, কিশোর, হেনা, খোকা, খুকু, মধু, ইসলাম, করিম, দিলশাদ এদের সঙ্গে আমার দেখা হয় না! শৈশবের স্মৃতিগুলো মনে পড়তে লাগলো। তখন আবার শিখার মুখ মনে পড়লো। ফর্সা, দীর্ঘচুল, টানা টানা---ভেজা ভেজা চোখ, লম্বাটে মুখের মেয়েটির সঙ্গে সেই যে যুদ্ধের আগে শেষ দেখা হলো স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত আর সাক্ষাৎই ঘটলো না! কী আশ্চর্য! অথচ একই শহরে থাকি আমরা! এমনওকি হয়! হতে পারে? আমি যখন ওদেরকে ভুলে গেছি ওরাও নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে গেছে। শুধু দীপু একই স্কুলের ছাত্র বলে প্রতিদিন দেখা হয়।

এখানে আসার পর দুবছর হয়ে যাচ্ছে এর মধ্যে একদিনও আমি পুরনো জায়গায় যাবার চিন্তাই করিনি! মা যায় সময় পেলেই আমি জানি। বাবাও যে যায় এটা জানতাম না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। মানুষ সাধারণত সামনের দিকে ধায়। পেছনের দিকে সে ফিরে তাকায় খুব কম। তারুণ্যে সেটা হয়ও না। সেই দুর্দান্ত, দুরন্ত তারুণ্যকে থমকে দিল বাবাই হঠাৎ করে কিছু নস্টালজিক কথা বলে। অন্যরকম মনে হলো এই প্রথম তাকে। বাবা কী কবি? তাই কি বাবা আমাকে সিলেটে পাঠায় প্রতিবছর বর্ষায়? তবে বাবার মধ্যে যে একটি কবিমন আছে সেটা তাঁর গুনগুনকরা নজরুলগীতি গাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুভব করেছি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাবার ধারণা তিনি হচ্ছেন প্রকৃতিবন্দনার কবি, মননশীল বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কবি---সর্বোপরি ত্রিকালদর্শী মহামানব। আর নজরুল হচ্ছে তারুণ্যের কবি, জাগরণের কবি আর সূক্ষ্মজীবনবোধের শিল্পী। একবার বাবাকে তার প্রিয় গানের বিষয়ে জানতে চাইলে যে গানটির কথা বললো সেটা কোনোদিন শুনিনি আমি। সচরাচর রেডিওতে শোনা জনপ্রিয় নজরুলগীতি ছাড়া অন্য নজরুলগীতি কানে আসতো না বললেই চলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে ছেলেবেলা থেকেই ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করেছিল বাদলাদিনের ঘনঘোর মেঘের মতো। নজরুলের গানকে আবিষ্কার করতে শিখিয়েছে আমার বাবা।

যখনই রেডিওতে নজরুলের গান বাজতো বলতো, ‘বন্ধ করো না গানটি শুনতে দাও।’ পঁচাত্তরের পর তো নজরুলেই বাবা সমাধীস্থ হয়ে গেল যেন। প্রিয় গানটি কি জানতে চাইলে বললো, ‘ফিরোজা বেগমের ‘গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙ্গে যায়/কে যেন আমারে ডাকে/সেকি তুমি!’ শুনে আমি তো হেসে গড়িয়ে পড়ি কি মরি! এমন কী গান এটা যে বাবার সবচেয়ে প্রিয় হতে পারে! বললাম, ‘বাবা তুমি কি ছ্যাক্ খেয়েছে কখনো?’ বাবা হেসে বললো, ‘আমি জানি তুমি এমনই ভাববে এবং উত্তর দেবে। কারণ তোমার এখনো এই গানের মর্ম বোঝার বয়স ও সময় হয়নি। তবে হবে। আমি ছ্যাক্-ট্যাক্ খাইনি বাবা। জীবনে প্রেম এলে তো ছ্যাক খাওয়ার প্রশ্ন আসে। গ্রামেগঞ্জে মানুষ। সেখানে প্রেম কোথায় শহরের মতো! এই গানটির বহুমুখী অর্থ আছে বাবা। একজন কবি বা লেখক যখন কিছু লিখেন তখন তার রচনার বহুমুখী অর্থ থাকে। তাই তাদেরকে বলা হয়, মাল্টিকালারড জিনিয়াস। লেখা অত সহজ নয় পটুমিয়া, ওটা কঠিন এক সাধনা। সবাই সফল হতে পারে না। লেখালেখির সঙ্গে উচ্চশিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। লেখার বিষয়টা সূক্ষ্মবোধ আর ধারালো যুক্তির সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি বিস্ফোরক যা পাঠকের চরিত্র ও চিন্তাচেতনাকে আঘাত করে। সেই আঘাত থেকে পাঠক ভাবতে শিখে, অর্থ খুঁজতে প্রবৃত্ত হয়। এবার ভাবো হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ পাঠকের মনে পাথরের মতো নির্জীব চিন্তা-চেতনাকে জাগাতে, প্রাণ দিতে কী পরিমাণ বিষ্ফোরণ ঘটায় লেখকরা প্রতিদিন! কী শক্তিশালী তারা ভেবে দেখেছো কখনো?

সাধে কী বলে, কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র আর তরবারির চেয়েও শক্তিধর।’ বাবা কী দার্শনিক নাকি সাধারণ একজন পুলিশ অফিসার মাত্র? এই চিন্তা আমাকে পেয়ে বসতো মাঝে মাঝে। বাবা বিস্তর পড়ে সেটা আমি জানি। বই আর চশমা তাঁর বালিশের কাছে থাকেই। কাজের মধ্যেও রিল্যাক্স করার জন্য অফিসে দেখেছি চেয়ারে পা ছড়িয়ে উপন্যাস পড়তে। কিন্তু বাবা যে কবিও সেটা প্রথম বুঝতে পেলাম গভীরভাবে যখন কলেজ জীবনে একাধিক হৃদয়ঘটিত ঘটনার জলোচ্ছ্বাসে ভিজে জবুথুবু, বিষণ্ন, অবনত হয়ে পড়েছিলাম আমি তখন। সব কবিরাই লিখে রাখেন কাগজে আর কোনো-কোনো কবি যে প্রতিনিয়ত অগোচরে শূন্যতার উপর লিখে রেখে যান তাঁদের একজন আমার বাবা। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বাবা আসলেই কবি। ...চলবে।

আলোকচিত্র : উপরে, ধর্মসাগর পশ্চিম পাড় পাড়া যেখানে কেটেছে আমার যৌবনের উত্থান পর্ব । নিচে, ধর্মসাগর পাড়ে থাকাকালীন যার সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি সেই শতদল রায় সরকার ওরফে প্রিয় শতদলদা এখন।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ১৩, ২০১৪)