স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর : কী জানি, কবে কখন কার হাঁড়ি ভেঙ্গেছিল কেন এর কোন সঠিক তত্ত্ব উপাত্ত নেই
কারো কাছেই। তবে কোন এক যুগ সন্ধিক্ষণে কোন এক মাটির ভাঙ্গা হাঁড়িকে ঘিরেই উৎপত্তি হওয়ায় নাম হয়েছে ‘হাঁড়িভাঙ্গা’। আর এই ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ ই এখন মাতিয়ে তুলেছে রংপুরসহ পুরোদেশ। হাঁড়িভাঙ্গা যাচ্ছে বিদেশেও।

না! ভাঙ্গা কোন হাঁড়ি কিংবা পাতিল নয়, আমের নাম ‘হাড়িভাঙ্গা’। বাংলাদেশে একমাত্র রংপুরেই উৎপাদিত হয় এ আম। সেটিও আবার শুধুমাত্র মিঠাপুকুর উপজেলার বিশেষ কয়েকটি এলাকাতে। সেখানেই গড়ে উঠেছে এর বিশাল হাট। সেখানকার মাটি এবং আবহাওয়া এ আমের জন্য বিশেষ অনুকূল হওয়ায় একমাত্র সেখানেই চলছে এর আবাদ-উৎপাদন।

হাঁড়িভাঙ্গার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, সম্পূর্ণ আঁশবিহীন আকারে বড়, ছোট আঁটি, হলদে রং আর স্বাদ যেন অমৃত। একটি কিংবা দুটো খেলে তৃপ্ত হওয়া যায় না। আর রসনাবিলাসীদের মতে, এর স্বাদ ও গন্ধ প্রচলিত ল্যাংড়া, রাজভোগ, গোপালভোগ, হিমসাগর আর আধপালিকেও ছাড়িয়ে গেছে। সবকিছু মিলেই ভিন্ন জাতের এ আম খুব অল্প সময়ে রংপুরের গন্ডি পেরিয়ে এখন দেশ খ্যাত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের মাধ্যমে প্রতিদিনই ট্রাকে ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ চলে যাচ্ছে দেশ-দেশান্তরে। স্থানীয়রাও নিজেদের রসনা
মিটিয়ে দুর-দূরান্তে থাকা আত্মীয় পরিজনদের জন ̈ বিভিন্ন পার্শ্বেল এবং পরিবহনে উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছেন এই আম। এবারের রমজানে এ অঞ্চলের রোজদারদের পাতে কমন আইটেমে পরিণত হয়েছে এই হাঁড়িভাঙ্গার আম।

নগরীর ফলের দোকানগুলোতো বটেই, সড়কের ফুটপাত আর পাড়া মহল্লার অলিগলিও এখন সাইকেল
কিংবা ভাড়-এ করে নিয়ে আসা আম বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখর। ‘ল্যাংড়া’ জাতের এক বিশেষ আমের জন্য এককালের চাপাইনবাবগঞ্জ বিখ্যাত হলেও রংপুর এখন নতুন করে বিখ্যাত হয়ে উঠছে এই ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ আমের জন্য এমন মন্তব্য খোদ ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ নামের উৎপত্তি বহুকাল আগে হলেও এর পথচলা আর জনপ্রিয়তা খুব বেশি আগের নয়। নামের উৎপত্তি নিয়ে দু’ধরণের তথ্য পাওয়া যায়।

কেউ বলেন, উপজেলার বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের হেলেঞ্চা গ্রামের নফল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি ফেরি করে আমের ব্যবসা করতেন। সেখানকার রাজবাড়ির একটি গাছের আম অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় তিনি ওই গাছে কলম করে একটি চারা বানিয়ে লাগান তার নিজ বাড়ি তেকানি গ্রামে। সেই চারায় ফিল্টার পদ্ধতিতে পানি দেয়ার জন্য একটি মাটির হাঁড়ি যুক্ত করেন। পরবর্তীতে কে বা কারা ওই হাঁড়িটি ভেঙ্গে ফেলে। পরে গাছটিতে থোকায় আম ধরে এবং সে আম খুবই সুমিষ্ট হয়। তখন অনেকেই খেয়ে জানতে চায়, এটি কোন গাছের আম ? জবাব আসে ‘ওই যে ভাঙ্গা হাঁড়ির গাছের আম’। আর সে থেকেই এর নামকরণ হয় ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ আম।

আবার কেউ বলেন, ওই গ্রামে বাস করতেন সোহরাব কাসারী নামে এক কুমোর। তিনি মাটির হাঁড়ি পাতিল তৈরি এবং ফেরি করে বিক্রি করতেন। একদিন কোন এক স্থান থেকে একটি আম কিনে খেয়ে আঁটিটি ফেলে দেন পেছনের ঝোপে ভাঙ্গা হাঁড়ি পাতিলের ঝোপে। ওই আঁটি থেকে জন্ম নেয়া গাছে আম ধরলে তা বেশ সুস্বাদু হয়। তখন সবাই জানতে চায়, কোন গাছের আম ? তখনও একই জবাব ভাঙ্গা হাঁড়ির গাছের। পরবর্তীতে ওই গাছে একে একে কলম করে বাণিজ্যিক একটা সময় ‘হাড়িভাঙ্গা’র খ্যাতি মিঠাপুকুরের নির্দিষ্ট এলাকাতেই সীমবদ্ধ থাকলেও ৯২ সালে প্রথম বানিজ্যিক ভিত্তিতে এর আবাদের সম্প্রসারণ ঘটান।

স্থানীয় আখিরাহাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সমবায় কর্মকর্তা আলহাজ্ব আব্দুস সালাম। প্রথম বছরেই অভাবনীয় সাফল্য পান তিনি। পরবর্তীতে আম চাষে বহু পুরষ্কারও পেয়েছেন তিনি। তার সাফল্য দেখে পরে তা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী উচাবালুয়া, পদাগঞ্জ, হেলেঞ্চা, আখিরাহাট, পাইকারেরহাট, এবং সংলগ্ন বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর দুর্গাপুরসহ বেশ কিছু গ্রামে। এসব এলাকার এমন একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বাড়ির আঙ্গিনায় এ আমের গাছ নেই। আবার বোধকরি রংপুর এলাকার এমন একটি পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, তার বাসায় দু/চার/পাঁচ কেজি ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ আমের মজুদ নেই।

সঙ্গতকারণেই ধরে মিঠাপুকুরের সবচে বেশি আম উৎপাদনকারী এলাকা পদাগঞ্জ। পদাগঞ্জকে বলা হয় এ অঞ্চলের আমের রাজধানী। রবিবার সেই পদাগঞ্জসহ আশপাশের বেশ কিছু বাগান ঘুরে দেখা গেল, প্রতিটি বাগান এবং বাসা বাড়ির গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে আম। উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীরা জানায়, জুন মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে হাঁড়িভাঙ্গা পুষ্ট এবং পাকতে শুরু হলেও বাইরে থেকে আসা পাইকারেরা আগেই বাগান কিনে নেন। আখিরাহাট এলাকায় ৮ একর জমিতে ‘দয়ার দান আম্রকানন’ নামে বাগান রয়েছে আব্দুস সালামের। তিনি জানালেন, এবার আগেই এক ব্যবসায়ী তার বাগান ১৩ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছেন।

তিনি আরো জানান, মৌসুমের শুরুতে ২ হাজার থেকে ২২’শ টাকা মন দরে আম বিক্রি হলেও এখন তা আকার ভেদে ২৪’শ থেকে ২৮’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমান পাইকারী কেজি মূল্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর খুচরা ৬৫ থেকে ৭০টাকা। প্রতিদিন দাম বাড়ছে। গত বছর শেষ দিকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মন বিক্রি হয়েছে। রংপুর কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক কমল কুমার সরকার জানালেন, এবার রংপুরে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে এ আমের আবাদ হয়েছে। আম চাষির সংখ্যাও এখন ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এটি মাঝারি আকারের আম এবং এর একেকটির গড় ওজন হয়ে থাকে ২৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত। এর মিষ্টতার পরিমাপ ২০.৫ থেকে ২২.০ পর্যন্ত। চাষি এবং কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর দেড় থেকে ২’শ কোটি টাকার হাঁড়িভাঙ্গা বেচাকেনা হলেও এবার তা অনেক বেশি ছাড়িয়ে গেছে।

উদ্যান বিশেষজ্ঞ এবং এ আমের গবেষক খন্দকার মেসবাহুল ইসলাম জানান, জুন মাসের
তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে হাঁড়িভাঙ্গা জাতের আম পুষ্ট বা পরিপক্ক হয় এবং আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তা সংগ্রহ করা যায়। তিনি জানান, অসৎ ব্যবসায়ীরা জুন মাসের শুরু থেকেই রাসায়নিক উপায়ে একে পাকাতে শুরু করে। তিনি জানান, সম্পূর্ণ হলদে যে আমগুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো আসলে কৃত্রিম উপায়ে রাসায়নিকভাবে পাকানো হয়। এ জন্য তিনি কড়াকড়ি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ আরোপ করে নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাজারে যাতে এ আম না আসে সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করেন।

হাঁড়িভাঙ্গার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা প্রসঙ্গে এ আমের সম্প্রসারক আলহাজ্ব আব্দুস সালাম এবং অতিরিক্ত পরিচালক কমল কুমার সরকার জানান, যেহারে হাঁড়িভাঙ্গার বিস্তার লাভ করছে তাতে এটি হয়ে উঠতে পারে এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরি ফসল। তারা জানান, গত কয়েক বছরের বাজার মূল্য পর্যালোচনা করে বলা যায়, দেশের সব আমের চেয়ে এ আমের দাম অনেক বেশি।

(এমএস/জেএ/জুলাই ১৩, ২০১৪)