সাহিত্য ডেস্ক : দেখতে দেখতে কেটে গেল ছয়টি বছর। এখনও বিষাদের ছায়া সরেনি গজারি বনের ভেতরে নুহাশপল্লী থেকে শুরু করে হুমায়ূনভক্ত কোটি কোটি পাঠক-দর্শকের হৃদয় থেকে। নুহাশপল্লীর সবুজ মাঠ, দীঘি লীলাবতীর জল, ঔষধি বাগান, ছাতিম গাছের ছায়া, লেখার টেবিল, দেয়ালে টানানো প্রিয় ফটোগ্রাফি, বুকশেলফে সাজানো শত শত বই কিংবা প্রান্তরজুড়ে রাজহাঁসের দল- সবই আছে সেই আগের মতোই। শুধু নেই প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে দুরারোগ্য ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নন্দিত এই কথাশিল্পী।

নিজের আত্মজৈবনিক গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন- কল্পনায় দেখছি নুহাশপল্লীর সবুজের মধ্যে শ্বেতপাথরের কবর, তার গায়ে লেখা- ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে’। সে কথাগুলো কাচের এপিটাফ করে তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন নিজের নকশায় সাজিয়েছেন স্বামীর কবর। সেখানে আজ শাওন আর দুই শিশুপুত্র নিষাদ ও নিনিতের ফুলের ছোঁয়া পাবেন তিনি। তারপর হাজারো ভক্ত-অনুরাগী নুহাশপল্লীর লিচুতলায় বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবেন তাদের প্রিয় লেখককে।

ছয় বছর আগে, ঘোর অমাবস্যার রাতে জ্যোৎস্নাপ্রেমী হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা থেকে বহু দূরে নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চার দিন পর জন্মভূমির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিথর হুমায়ূনকে ভালোবাসার অর্ঘ্য প্রদান করেন লাখো মানুষ। পরদিন ২৪ জুন নুহাশপল্লীর লিচুতলায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এ লেখককে।

১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ, একই সঙ্গে শুরু তার বিস্ময়কর জয়যাত্রা। কথাসাহিত্যে অভূতপূর্ব দক্ষতা প্রদর্শনের পাশাপাশি তিনি নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনক; তার রচিত ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ [১৯৭৩] বাংলাদেশের প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।

সাড়ে তিন শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প, কবি, লীলাবতী, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, মধ্যাহ্ন, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, নক্ষত্রের রাত প্রভৃতি। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটুপুত্র কমলা। টিভি নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম কাজল। বাবা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। তারা তিন ভাই ও দুই বোন। জনপ্রিয় লেখক, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

১৯৭৩ সালে গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন ও গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার লাভ করেন।

এখনও সমান জনপ্রিয় মৃত্যুর অর্ধযুগ পরেও হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এখনও বিক্রির শীর্ষে অবস্থান করেন তিনি।

হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিক্রির শীর্ষ তালিকাতেই নাম থাকে হুমায়ূন আহমেদের। নতুন বই না থাকলেও পুরনো বই নিয়ে বেশ সদর্পেই বইয়ের মেলায় নিজের উপস্থিতি জানান দেন হুমায়ূন আহমেদ।

এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশক কাকলী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এ কে এম নাছির আহমেদ সেলিম বলেন, হুমায়ূন আহমেদের পাঠকসংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। এর কারণ, আজ যে পাঠকের জন্ম হলো, তার কাছে হুমায়ূন আহমেদ এবং তার সৃষ্টিকর্ম নতুন। সেই বইগুলো তারা সংগ্রহ করছেন এবং পড়ছেন।

হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় সর্বমোট ১৫টি প্রকাশনা সংস্থা থেকে তার বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো- অনন্যা, অন্যপ্রকাশ, অনুপম, অন্বেষা, অবসর, আফসার ব্রাদার্স, কাকলী, জ্ঞানকোষ, প্রতীক, সুবর্ণ, পার্ল পাবলিকেশন্স, মাওলা ব্রাদার্স, শিখা প্রকাশনী, সময়, সন্ধানী ও সাগর পাবলিশার্স। মৃত্যুর পর তার বইয়ের সংকলন প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি। এসব প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লেখকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হয় হুমায়ূন আহমেদের বই। যার রয়্যালিটি মুসলিম পারিবারিক আইন-১৯৬২ এবং মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারীদের দেওয়া হয়।

আইন অনুযায়ী, হুমায়ূনের বইয়ের রয়্যালিটি ও অন্যান্য সম্পত্তির মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের মা সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ ও স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন আট ভাগের এক ভাগের মালিক হবেন। বাকি সম্পদ এক পুত্র সমান দুই কন্যা হিসেবে ভাগ হবে নয় ভাগে। নয় ভাগের তিন ভাগ পাবেন তিন মেয়ে- নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ। বাকি ছয় ভাগ পাবেন তিন ছেলে- নুহাশ, নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন। গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটার কারণে তিনি হুমায়ূন আহমেদের উত্তরাধিকার নন। হুমায়ূন আহমেদের সর্বাধিক বইয়ের প্রকাশক অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন-১৯৬২ এবং মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী প্রকাশকরা প্রতিবছরে যার যার সুবিধামতো সময়ে রয়্যালিটির চেক পাঠিয়ে দেন। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ মারা যাওয়ার পর তার অংশের রয়্যালিটি তার দুই ভাই অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব এবং দুই বোন সুফিয়া হায়দার ও মমতাজ আহমেদ পান। এ নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের কোনো ক্ষোভ নেই বলেও জানান তিনি। হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই আহসান হাবীব জানান, তার মায়ের অংশের রয়্যালিটির টাকা ব্যাংকেই জমা পড়ছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই টাকা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের নামে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য মেধাবৃত্তি প্রদান করা হবে।

উত্তরাধিকারের এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তিনি বলেন, মৃত্যুবার্ষিকীর আগে এসব বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। পরে এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।

আজ নানা আয়োজন

হুমায়ূন আহমেদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের জন্য কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বাদ জোহর দোয়া মাহফিলের পর হুমায়ূন-স্মরণ অনুষ্ঠিত হবে। এতে শিশুরা অংশ নেবে। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় চরিত্র ‘হিমু’কে ঘিরে গড়ে ওঠা সংগঠন হিমু পরিবহন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে আজ দিনভর হুমায়ূন আহমেদের নাটক, চলচ্চিত্র পরিবেশিত হবে।

(ওএস/এসপি/জুলাই ১৯, ২০১৮)