চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : বিএনপির দুর্গখ্যাত কর্ণফুলীতে মাঝখানে আশা জাগিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বর্তমানে তা অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে পুরা উপজেলায়। ঝিমিয়ে থাকা নেতাকর্মীদের নেই কোনো দলীয় কর্মকান্ড।

উপজেলার ৫টি-ইউনিয়ন ও প্রতিটি ওয়ার্ডের সর্বত্রই স্থবিরতা। নেতারা ব্যস্ত ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। যদিও সাংগঠনিক সমস্যা না থাকায় এক নেতার একাধিক পদ। স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপর মন্ত্রীত্বেও চাপ থাকলেও প্রতিমাসে ঠিকেই এলাকায় আসেন। তারপরেও কর্মীদের সাথে তৈরি হয়েছে নেতাদের দুরত্ব। বলা যায়, কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগ অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়। প্রশাসনিক কর্মকান্ড আর মন্ত্রীদের সফরকালে মিডিয়ায় মুখ দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কার্যক্রম।

জানা যায়, বিগত ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর ১৫ সদস্য বিশিষ্ট এডহক কমিটি গঠনের পর থেকে কয়েক মাস চাঙ্গাভাব দেখালেও নির্জীব হয়ে পড়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। পরে এডহক কমিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেও সুফল পায়নি বরং তৃণমূল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন নেতারা। মাঠে থাকা কর্মীদের সাথে দুরত্ব বাড়ছে দিন দিন।

অন্যদিকে এডহক কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ করার কথা থাকলেও ৪বছরেও তা করা হয়ে উঠেনি। সামনে জাতীয় নির্বাচন, দেখা যাচ্ছে সভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ অসুস্থতাজনিত কারণে অনেকটা দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় । সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী রনি মাঠে সরব বলে দাবি করলেও একার কার্যক্রমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছেনা পুরা উপজেলার দলীয় কর্মকান্ড। জানা যায়, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ ও ওয়ার্ড কমিটি গুলোর অবস্থা আরো নাজুক।

ফলে আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই হয়ে পড়েছে সামাজিক সাইট কিংবা ফেসবুক নির্ভর। এমন অবস্থায় হতাশা দেখা দিয়েছে কর্ণফুলীর তৃণমূল আওয়ামী পরিবারে।

আওয়ামী লীগের এই নিষ্ক্রিয়তার প্রভাব পড়েছে সর্বশেষ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও। অনেকে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় নেতাদের সাথে কর্মীদের বিচ্ছিন্নতা তৈরিসহ নানা সমালোচনায় মুখর ছিলো তখন। উপজেলার চরলক্ষ্যা, জুলধা, বড়উঠান, চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাধিক তৃণমূল নেতাকর্মীরা অভিযোগ তুলেছে, কর্ণফুলীতে রাজনীতি নয়, বরং ব্যবসা বানিজ্য ও তদবিরে ব্যস্ত পদে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা। যারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাথায় রাখছেনা।

দেখা যায়, বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মধ্যেই এখন সীমাবদ্ধ কর্ণফুলী আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। সাংগঠনিক তেমন কোনো কর্মকান্ড নেই বললেই চলে। কেবল দলের নেতা ও মন্ত্রীরা এলাকায় সফরে আসলে তাদের সাথে বিভিন্ন কর্মসূচীতে যোগদান, ফটোসেশন আর প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মসূচী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ভূমিপ্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী’র টেবিলে হাজিরা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেতাদের কার্যক্রম।

দলীয় কর্মকান্ডের চাইতে বেশিরভাগ নেতাই ব্যস্ত ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। নানা সুযোগ সুবিধা আদায় ও তদবিরবাজিতে ব্যস্ত অনেকে। প্রথম সারি থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতারাও এখন ব্যস্ত নানা পদ-পদবী, প্রকল্প আর সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিতে।

এভাবে যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নেতারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে তবে কঠিন হয়ে পড়বে সামনের জাতীয় নির্বাচন। ভোটের রাজনীতিতে এ আসনে বিজয়ী হতে নৌকা প্রতীকের ঘাম ঝরিয়ে যাবে বলে ধারণা করছে।

সাংগঠনিক অচলবস্থার কারনে শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পন,সামাজিক অনুষ্ঠানে ফটোসেশন ব্যতিত আর কোনো কর্মসূচীই পালন করতে পারেনি উপজেলা আওয়ামী লীগ। অন্যান্য বছর মতবিনিময় সভা,বর্ধিত সভা, তৃণমুলে কর্মীসভা, আলোচনা সভা, সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচী ও জাতীয় দিবসে উপজেলা আওয়ামী লীগ পৃথকভাবে বড় পরিসরে কর্মসূচী আয়োজন করলেও এখন তাও অদৃশ্য।

দল ক্ষমতায় থাকার পরও উপজেলার এমন করুণ অবস্থা মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করছে। তাদের অভিযোগ, সামান্য আপদে বিপদে অনেক চেষ্টা করেও নেতাদের পাশে পান না। সবকিছুতেই সংসদ সদস্য ও জেলা কিংবা মহানগর নেতাদের পিছনে ছুটতে হয়। কেননা দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড জোরদার করার বদলে নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতেই অধিক মনোযোগী বলে অভিযোগ তৃণমূলের।

সুুত্রে জানা যায়, জুলধা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সক্রিয় নন। বরং সাঃ সম্পাদক একের ভিতর দুই (ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাঃ সম্পাদক), ফলে দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো একেবারেই হযবরল অবস্থা! কেননা সভাপতি বেসরকারী ইউসিবিএল ব্যাংক মইজ্জ্যারটেক শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছেন আর সাধারণ সম্পাদক ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে ব্যস্ত। দলীয় কর্মসূচীর ধারে কাছে কেউ নেই বলে প্রচলন রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জুলধা ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি আমির আহমেদ বলেন, “একেবারেই যে আমরা মাঠে নেই তা নয়। সামনে আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে বসে দলীয় কর্মসূচীর প্রস্তুতি নিচ্ছি”।
এদিকে চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতির সক্রিয়তার দেখা মিলে এলাকায় কিন্তু সাঃ সম্পাদক প্রায় দলীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।

বলতে গেলে শিকলবাহা একটি বিশাল ইউনিয়ন । ভোট ব্যাংক প্রচুর কিন্তু ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি একের ভিতর তিন (উপজেলা পুরুষ ভাইস-চেয়ারম্যান, জেলা যুবলীগে'র সহ-সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি) দায়িত্ব পালন করছেন। দলীয় কর্মসূচী তো দুরের কথা সাধারণ সম্পাদক নিজেও নাকি সভাপতির দেখা পায় না।

চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সক্রিয় থাকলেও সাঃ সম্পাদক দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর গত কিছুদিন আগে মারা গেলে স্থবির রয় সাংগঠনিক কর্মকান্ড। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতি আলহাজ্ব সৈয়দ আহমদ বলেন, “অন্যান্য ইউনিয়নের কথা বলতে পারবনা। তবে আমার ইউনিয়নে আমরা কেন্দ্রঘোষিত সকল কর্মসূচী যথাযথ ভাবে পালন করে আসছি,ভবিষ্যতে ও করে যাবো”।

অপরদিকে বড়উঠান ইউনিয়ন আওয়ামীলীগও প্রায় নিষ্ক্রিয়। এই ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ এর কার্যক্রম বলতে গেলে একপ্রকার সম্পাদকের উপর নির্ভরশীল। সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা হওয়ায় জাতীয় দিবস বা কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচী গুলো যথাযথ ব্যবস্থায় না হলেও সাধ্যমত পালনের চেষ্টা করেন। সভাপতি দলীয় কার্যক্রমে কোনমতেই সক্রিয় ভূমিকা বা নিজ দায়িত্বটুকুও পালন করছেন না বলে প্রচার রয়েছে। সভাপতির সাথে সমন্বয়ের অভাবে অনেক কর্মসূচীও নাকি যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করতে পারছেনা বলে ও জানা যায়।

সামনে জাতীয় নির্বাচন কড়া নাড়ছে আওয়ামীলীগের মূল সংগঠনের এই অবস্থা হলে নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে বলে মনে করেন পাঁচ ইউনিয়নের তৃণমূল ও অঙ্গসংগঠন ।

অভিযোগ রয়েছে, রাজনীতির পদ দখল করে রাজনীতি না করে জেলা উপজেলার গুটি কয়েক নেতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা যেমন-তৈলের ব্যবসা, ঘাট ও হাটবাজারে ইজারায় অংশীদার, পাথর ও কয়লা মজুদদারী ব্যবসা, শহরে গোডাউন ব্যবসা, ক্যাট বাংলাতে পাথরের ব্যবসা, জমি জামার ব্যবসায় সিন্ডিকেট গড়ে প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার কিছু নেতা চোখের সামনেই কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। যা স্থানীয় সংসদ সদস্যের অগোচরে রয়েছে বলে জানা যায়।

তৃণমুলের এক নেতা জানান, দল করতে হলে দলের প্রতি আনুগত্য থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়নে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কথা নেতাকর্মীদের। অথচ তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির নামে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টার পরে কর্ণফুলী আ’লীগের সাঃ সম্পাদক হায়দার আলী রনি’র কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর, পরে কথা বলবেন বলে ফোন রেখে দেন।
অপরদিকে কর্ণফুলী আ’লীগের সভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ কে মেসেজে ক্ষুদেবার্তা ও ৩৯বার কল করেও কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

রাজনীতিতে কর্ণফুলী উপজেলা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল রয়েছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব মোসলেম উদ্দিন বলেন, “সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল সেটা বলা যাবেনা তবে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে সেটা বলতে পারি। আমরা কর্ণফুলী বিষয়ে গতকালও বৈঠক করেছি । স্থানীয় সংসদ ভূমিপ্রতিমন্ত্রীকেও জানিয়েছি। আশা করি দ্রুত একটি পদক্ষেপ নেওয়া হবে কেননা সামনে জাতীয় নির্বাচন”।

(জেজে/এসপি/জুলাই ১৯, ২০১৮)