বিশ্বজিত বসু


তখন আমার বয়স কতছিল! আট বা নয়। কবি বলতে বুঝি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বন্দে আলী মিয়া। কবিতার বই বলতে বুঝি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। বাড়ীতে মোটা মোটা তিনখানা বই। আলমারীতে। রামায়ণ, মহাভারত আর সঞ্চয়িতা। মাঝে মাঝে আলমারী থেকে রামায়ণ কিম্বা মহাভারত বের করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চার রঙা ছবি দেখি আর নিচে কবিতার ছন্দে লেখা ছবির বর্ণনা পড়ি। মহাভারত কিম্বা রামায়ণকে কাব্য গ্রন্থ হিসাবে চিহ্নিত করার মত বোধদয় তখন হয়নি।

দুপুরে খাবারের পর রান্নঘরের বারান্দা মাটি দিয়ে লেপে সেখানে বসে রামায়ন বা মহাভারত পাঠের আসর। পাঠক হিসাবে কখনও ঠাকুমা অমিয়া বসু, বড়মা মৃণালিনী বসু, মঞ্জু পিসি। সেই বয়সে কখনও সে সে রামায়ণ বা মহাভারত পাঠে বসতাম। কখন আশেপাশে খেলাধুলা চলতো। আশে পাশে খেলাধুলা চললেও কান মনে হয় সজাগ থাকত সর্বদা। ফলে সে সময়ে শোনা রামায়ণ বা মহাভারতের ঘটনাবলী যেমন কিছু কিছু মনে আছে। তেমনি মা ঠাকুমাদের মধ্যে যে আলোচনাগুলো হতো তারও কিছু কিছু মনে পড়ে। কিছু কিছু আলোচনা মনে রেখাপাত করে এবং গেঁথে থাকে মনের গহীনে।

ঠাকুমা বর্ণিত দুটি ঘটনা মনের মধ্যে গেঁথে আছে। একটি হচ্ছে "ফুলকাকা একটি ছোটগল্প লিখেছে ঠুলী। গল্পে ঠুলী বিবাহ বয়স্কা। হঠাত, মা মারা যায়। বাবা ঠুলীকে বিয়ে না দিয়ে নিজেই বিয়ে করে নিয়ে আসে। সেখানে ঠুলীর বাবা কি এক সাহা ভদ্রলোক গোয়ালচামট এলাকার ফুলকাকার নামে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিসটেট কোর্টে হানির মামলা করে। মামলা কোর্ট খারিজ করে দেয়।"

দ্বীতিয় যে গল্প তার সুত্রপাত হলো একটি বিয়ের চিঠি নিয়ে। টাকুর বিয়ে। টাকু দুর সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়া। আর বিয়ে হচ্ছে যে ছেলের সংগে সেও দুর সম্পর্কের আত্মীয়। সেই আলোচনায় ঠাকুরমার আলোচনায় উঠে এলো টাকুর দাদা কমল কবিতার বই বের করেছে। ছদ্মনামে। বাবু ফরিদী।

সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বন্দেআলী মিয়ার পরে চতুর্থ কবি বাবু ফরিদী। সবচেয়ে বেশী রেখাপাত করেছিল সে আমাদের আত্মীয়। কবিতার বই বের করার আগে আমাদের বাসায় এসে কাকা অরুন বসুর সংগে পরামর্শ করতো। সেই থেকেই বই বের কারার বিষয়টি ঠাকুরমার জানা।

ফরিদপুর আসার পর মনে মনে খুজতাম বাবু ফরিদীকে। তবে প্রথম কবে কোথায় প্রথম দেখা হয়েছে মনে করা সম্ভব না। তবে তাঁকে পরিপূর্ণ আবিস্কার করলাম কোন এক কবিতা পাঠের আসরে। তিনি আসতেন স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। কিন্তু মনে হতো তিনি তাঁর অন্য দুই আত্মীয় অরুণ বসু এবং তপন বোস সাংস্কৃতিক অঙ্গণে যে সময় এবং শ্রম দেন, সে তুলনায় তিনি অতটা জড়িত নয়। আরও পরে বুঝতে পারি সরকারি চাকরির কারণে সীমাব্ধতা ছিল। এ সীমাবদ্ধতাকে তিনি কবিতা লেখার মধ্যে দিয়ে পূর্ণ অতিক্রম করেছেন। ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের ফরিদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক।

আশির দশকে স্বেরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি কবিতা লিখতেন এবং পড়তেন নিয়মিত। সে সময়ে দুটো কবিতার লাইন ফরিদপুরে খুব জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে আমরা যারা রাজনীতি করতাম তাদের কাছে। লাইন দুটো এরকম

"সামনে গর্ত পিছনে শেয়াল

খুব খেয়াল।"

লাইন দুটো কেন যেন মনে হয় ওনার লেখা। অন্য কারো কবিতার হতে পারে। কিন্তু লাইনদুটো মনে মনে আবৃত্তি করার সময় বাবু কাকার মুখটাই ভেসে উঠে।

সে সময়ে যারা কবি হিসাবে পরিচিতি ছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবু কাকা অন্যতম। তিনি ছিলেন অনেকটা মধ্যমণি। এছাড়া যাদেরকে কবি হিসাবে লোকে চিনত তাদের মধ্যে আব্দুস সাত্তার গুমানী, নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ মুসা, আনোয়ার করিম, আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া, আ ন ম আব্দুস সোহবান, মনোরঞ্জন বোস, এনায়েত হোসেন, কমলেশ রায়, আবু জাফর দিলু, আবু সুফিয়ান খান, মমিনুল হক, পাশা খন্দকার, অঞ্জলী কর্মকার প্রমূখ।

এছাড়া আমার জানার মধ্যে আরো কবিতা বা ছড়া লিখতেন জালাল আহমেদ, কুশল চৌধুরী, জাফর মোল্যা, তপন বোস নান্নু, জাহাঙ্গীর খান,

আমাদের সমবয়সি বা কাছাকাছি বয়সিদের মধ্যে কবিতা লিখতো জোবায়ের স্বপল, গোবিন্দ বাগচী, নাদিরা নাহিদ লিপি, সুলতানা মিজান সুমি, অশোকেশ রায় প্রমুখ।

আশির দশকের শেষ দিকে বাবু কাকাদের বাড়ীতে আমার যাতায়াত বেড়ে যায়। বলা যায় সপ্তাহে দুদিন তিনদিন। ছোট ভাই কনক তখন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এবং বন্ধু। বাবু কাকার ছেলে দেবু তখন কেবল হাটতে শিখেছে। তখন সে তুর তুর করে হেটে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বাবু কাকার সাথে দেখা হতো। কথা হতো কেমন আছ ভাল আছি। কনকের খাটের নিচে থাকত আমাদের দেয়াল লিখনের সরঞ্জাম। কাকীমার চায়ের অফার মাঝে মধ্যে ফিরিয়ে দিয়ে চলে যেতাম মহিম স্কুলের মোড়ে মুন্নার দোকানে। সেখানে চলতো আমাদের আড্ডা ঘন্টার পর ঘন্টা।

একদিল সকালে ঢাকা যাব। দেখি ভাঙা রাস্তার মোড়ে বাবু কাকা দাঁড়িয়ে। ব্যাগ সিটে রেখে নেমে গেলাম। নাস্তা করার জন্য বাবু করার পাশে। বাবু কাকা ডেকে বললেন আয় গল্প দিয়ে রুটি খায়। চায়ের অর্ডার দিলেন। নিজে একটা রুটি নিলেন আমাকে একটা রুটি দিলেন। এক কামড় রুটি এক চুমুক চা। দুজনে খেতে এবং গল্প করতে থাকলাম। চায়ের কাপ শেষ হতে হতে আমরা দুজনে দুটি করে রুটি খেয়ে ফেলেছি। খাওয়া শেষে বললেন দেখ গল্প দিয়ে দুটো করে রুটি খেয়ে ফেললাম। একাধিকবার ব্যবহার করা তেলের তরকারীর চেয়ে গল্প দিয়ে রুটি অনেক বেশী উপকারী।

94 সনে আমি ঢাকা চলে আসি। তারপর আর দেখা হয় নাই। কিছুদিন পর শুনি কনকও চলে গেছে ভারতে। দীর্ঘদিন কোন খোঁজ জানতাম না। অস্ট্রেলিয়া আসার পর চেনা মানুষগুলোর কোন খোঁজ জানা আরও কঠিন হয়ে গেল।

ফেসবুকে ব্যবহার করা শুরু করার পর মনে মনে খুজতাম ফরিদপুরের কাউকে যদি পেতাম। কিছুদিন পর প্রথম যাকে পেলাম। তিনি মিলন ভাই। খন্দকার মিলন। মিলন ভাইকে পাওয়ার পর মনের সে এক অন্যরকম অনুভূতি আর আবেগ কাজ করেছিল। সেদিনই মনে হয়েছিল প্রিয় মানুষগুলোর খোজ এখন থেকে পাওয়া যাবে।

আস্তে আস্তে ফরিদপুর আমার প্রিয় শহরের অনেকেই পেতে থাকলাম ফেসবুকে। কোন একদিন ফেসবুকে কারও লেখা দেখে মনে হলো বাবু কাকা আমাদের মাঝে হয়ত নেই। কেমন যেন একটা বিষাদ মনে চেপে বসল। সত্যটা জানার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। এমন একটা সময়ে ফেসবুকে দেবুর সংগে যোগাযোগ। কিন্তু দেবুকে জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না। বাবু কাকা কেমন আছে বা তিনি কি মারা গেছেন? যদি বেচে থাকেন তাহলে কি ভাববে দেবু। শংকা নিয়ে শুধু অপেক্ষা করেছি। অনেক পরে একদিল দেবুর পোস্টের মাধ্যেমেই জানতে পারলাম বাবু কাকা নেই।

বড় হওয়ার পর কত কবির কবিতা পড়েছি, জসিমউদ্দীন, কামীনি রায়, রজনিকান্ত, রাম বসু, আল মাহমুদ, শামছুর রাহমান, রফিক আজাদ, শঙ্খ ঘেষ, পূর্নেন্দু পত্রী আরএ কত নাম। কিন্ত বাবু কাকাকে সামনাসামনি বলার সে সুযোগ আর কোনদিন হলো না। "রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বন্দে আলী মিয়ার পরে আমি কবি হিসাবে যার নাম জানি তিনি আপনি কমল কৃষ্ণ গুহ ওরফে বাবু ফরিদী ।

২০ জুলাই বাবু কাকার মৃত্যুবার্ষিকী। অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাঁর প্রতি রইল শত প্রণাম এবং শ্রদ্ধা।

(বিএম/এসপি/জুলাই ১৯, ২০১৮)