রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইনিয়নের চরপৌলী গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি এক রাতে যমুনার পেটে চলে গেছে। স্থানীয়রা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাক্ষুসী যমুনার ভাঙন তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ভাঙনের ফলে ওই এলাকার শতাধিক তাঁত ফ্যাক্টরি হুমকিতে রয়েছে। এলাকাবাসী স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে।

সরেজমিনে স্থানীয়রা জানায়, প্রতিবছর বর্ষায় যমুনার ভাঙন তাদের সবকিছু কেড়ে নেয়। বর্ষার সময় তারা দেড়-দুই মাস ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটায়। পানি বাড়তে থাকার চেয়ে কমার সময় ভাঙনের তীব্রতা বেশি থাকে। এবছর প্রথম দফায় পানি বাড়লেও গত এক সপ্তাহে প্রায় আড়াই ফুট কমেছে। একই সাথে যমুনার ভাঙনও বেড়েছে।

এ কারণে অনেকেই আগে থেকে যমুনা পাড়ের বাড়িঘর বিশেষ করে তাঁত ফ্যাক্টরি অন্যত্র সরিয়ে রাখেন। কিন্তু যাদের অন্যত্র জায়গা-জমি নেই তারা সরাতে পারেনি। ফলে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নিম্নবিত্তরা ভাঙনের শিকার হচ্ছেন। চরপৌলী গ্রামে বসবাসকারীদের ৭০ শতাংশ ব্যক্তি ২-৫ বার পর্যন্ত যমুনার ভাঙনের শিকার হয়ে বাড়িঘর তথা শাড়ির কারখানা সরিয়ে নতুন বাড়ী নির্মাণ করে বসবাস করছেন।

এলাকাবাসী জানায়, হঠাৎ করে যমুনা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রমত্ত্বা যমুনার শো শো শব্দের তীব্র স্রোতে মাত্র চোখের নিমিষেই নদী পাড়ের ঘরবাড়ি ও তাঁত ফ্যাক্টরি ভেঙ্গে যমুনার পেটে চলে যায়। অনেকে আগেই ঘর-তাঁত ফ্যাক্টরি সরিয়ে রেখেছিলেন, তাদের বসত ভিটা ও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি এবং ঐতিহ্যবাহী চরপৌলী হাটের শেষাংশ যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী ওই হাট-বাজারের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বাজারের রাস্তায় ৩-৪টি দোকান হাটের অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।

কাকুয়া ইউনিয়নের চর পৌলী গ্রামের আলহাজ, শেফালী বেগম, লালচাঁন মিয়া, জামাল মিয়া, আব্দুল আজিজ, সাত্তার ফকির, জড়িনা বেগম, সুফিয়া বেওয়া, মো. শান্ত মিয়া, হালিম আকন্দ, জুলহাস উদ্দিন, জবেদা বেওয়া, শহিদুল ইসলাম, ইউসুব আলী, লুৎফর রহমান, শাহাদত হোসেন, ইশারত আলী, আব্দুল খালেক, তাঁরা বানু, শরিফুল ইসলাম সহ শতাধিক ব্যক্তির বসতভিটা, তাঁত ফ্যাক্টরির জায়গা ও ফসলি জমি রাক্ষুসী যমুনা গিলে খেয়েছে।

স্থানীয় অধিবাসী মো. হাসেম আলী (৬০) জানান, আমার বাড়ী রাক্ষুসী যমুনা তিন তিন বার গিলেছে, প্রতিবারই তিনি পূর্ব দিকে সরে এসে বাড়ি করেছেন। এবারও ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছেন। তিনি জানান, এবার বাড়িটি ভাঙলে আর কোথাও বাড়ি করার সামর্থ তার নেই।

গত তিন বছরে যমুনার ভাঙনে চর পৌলী গ্রামের শাহজামালের ২৬টি তাঁতের ফ্যাক্টরি, রওশন আলীর ৩৬টি, শামছুল আলমের ২০টি, আব্দুস সবুরের ১৬টি, নুরুল ইসলামের ১০টি, আ. রশিদের ১২টি, আইয়ুব আলীর ১৬টি, শাহালমের ২০টি, সামছুলের ১০টি, মোকাদ্দেসের ৮টি, নুরুল আলমের ১৫টি, কদম আলীর ১০টি, আ. কাদেরের ১২টি ও সোনামিয়ার ১৮টি তাঁতের ফ্যাক্টরি সহ স্থানীয় প্রায় ৩০০ ছোট-বড় তাঁত ফ্যাক্টরি যমুনা গর্ভে বিলীন হয়েছে। তাদের কেউ কেউ যমুনার পূর্বদিকে সরে বাড়িঘর ও তাঁত ফ্যাক্টরি নির্মাণ করেছেন। যাঁদের সামর্থ নেই তারা ছিন্নমূল হিসেবে শহরে এসে যে যে কাজ পাচ্ছে তাই করে জীবিকা নির্বাহ করছে। কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তিকে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছে। এছাড়া অর্ধ শতাধিক দোকানপাট সহ চরপৌলীর ঐতিহ্যবাহী হাট ও বাজার, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬টি মসজিদ সহ বহু স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয় সমাজসেবক মো. শাখাওয়াত মন্ডল জানান, হঠাৎ করে যমুনা ফুসে ওঠে শতাধিক ঘরবাড়ি গ্রাস করেছে। চরাঞ্চলের মানুষ বাড়ি ভাঙা মানুষ। তাদের ভাল-মন্দ দেখার কেউ নেই। যাদের বাড়িঘর যমুনা গিলে খেয়েছে তাদের কারো ঘরে খাবার নেই, কারো পড়নে কাপড় নেই। সরকারিভাবে নদী ভাঙন এলাকার মানুষদের জন্য কোন সাহায্য-সহযোগিতা আসেনি। আমরা সামাজিকভাবে যেটুকু পারছি সহযোগিতা করছি। যমুনার ভাঙ্গন স্থায়ীভাবে রোধ করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি বেরী বাঁধ নির্মাণের দাবি করে আসছি।

চরপৌলী গ্রামের গৃহবধূ জেবুন্নেছা জানান, গত তিন বছর ধরে বাড়ি সরিয়ে অন্যের জমিতে ঘর উত্তোলন করে তিনি থাকছেন। এবারও যমুনার ভাঙন তার ঘরের পেছনে এসে পৌঁছেছে। এখন তার আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই। তিনি সরকারের কাছে মাথাগোঁজার ঠাঁই চান। তিনি রাক্ষুসী যমুনার ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ীভাবে একটি বাঁধ নির্মাণ করে তাদের শেষ সম্বল রক্ষা করারও দাবি জানান।

কাকুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, যমুনার ভাঙ্গন তাদের নিত্য সঙ্গী। প্রতি বছরই যমুনার ভাঙনে সাধারণ মানুষ মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। তাঁর বাড়িও গত বছরের বর্ষায় নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় তিনি পূর্ব দিকে সরে এসে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। প্রতি বছর প্রচুর আবাদি জমি বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়।

তিনি জানান, এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে আট কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটি বেরী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। বেরী বাঁধ নির্মাণ করা না হলে যমুনার করাল গ্রাস থেকে কোনভাবেই পরিত্রাণের উপায় নেই বলে মনে করেন তিনি।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাজাহান সিরাজ জানান, যমুনা নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে টাঙ্গাইলের পশ্চিমাঞ্চলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি বেরী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে।

(আরকেপি/এসপি/জুলাই ২৪, ২০১৮)