রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : দুই যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত সাপখালি ও পুটিমারা খালের উপর নেটপাটা দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এসব খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে গ্রামবাসী ও জবরদখলকারিরা মুখোমুখি অবস্থান করছে। যে কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কালিগঞ্জ সহকারি কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের চুনা নদীর মৌতলার চাতরা স্লুইজ গেট থেকে সাপখালি খাল প্রবাহিত হয়ে নেঙ্গি, বামনহাট, পারুলগাছা , ফরিদপুর, বেজুয়া , লক্ষীনাথপুর হয়ে যমুনা নদীর সঙ্গে মিশেছে।

ওইসব গ্রাম ছাড়াও জিরনগাছা , উত্তরশ্রীপুর, দক্ষিণশ্রীপুর, চাঁচাই, হোগলা, জয়পত্রকাটি, মুকুন্দমধুসুধনপুর, কোমরপুর, শ্রীরামপুরসহ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ৪০টি বিলের বর্ষার পানি সাপখালি খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়।

একইভাবে কালিকাপুরের ডাগরখালি থেকে পুটিমারার খালেরউৎপত্তি হয়ে কোমরপুর, বন্দকাটি, নৌবাসপুর, জয়পত্রকাটি, নীলকণ্ঠপুর হয়ে বাঁশতলা খালে মিশেছে। ওইসব গ্রাম ছাড়াও তিনটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি বিলের বর্ষার পানি এ খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে আসছে। স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ ও খেটে খাওয়া মানুষ বংশপরম্পরায় ওইসব খালে মাছ ধরে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

শুক্রবার সকালে সরেজমিনে ফরিদপুর গ্রামে গেলে আহছানউল্লাহ তরফদার, জিন্নাত আলী, অজিয়ার রহমান ও রজব আলীসহ কয়েকজন জানান, বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আলম ঢালীর নেতৃত্বে শাজাহান ঢালী, বাদশা, সেকেন্দার ১০/১২ জনের একটি টিম ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে সাপমারা খালের আমিন শেখের দীঘের পাশ থেকে বকলমরারদহ পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল দখল করে গৌরানা খালের মুখে, বকলমরাররদহসহ পাঁচটি স্থানে খালের উপর আড়াআড়ি নেটপাটা দিয়ে মাছ চাষ শুরু করে।

প্রতিবাদ করায় এলাকাবাসী হুমকির সম্মুখীন হয়। কোন কোনস্থানে নেটপাটা তুলে দিলেও জবরদখলকারি ওই মহলটি অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এলাকায় ভীতি সৃষ্টি করে আবারো নেটপাটা দেয়। ফলে জেলে ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকা বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে শহরে রিক্সা , ভ্যান বা ইজিবাইক চালাচ্ছে। গত বছর বর্ষা কম হওয়ায় সমস্যা নাহলেও বর্তমানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় খালে পানি বেড়েছে। আরো কয়েকদিন বৃষ্টিপাত অব্যহত থাকলে বিলের পানি খাল দিয়ে নদীতে না পড়তে পারলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে। এতে খালের দু’ ধারের কয়েক’শ চিংড়ি ঘের ও কয়েক হাজার বিঘার ফসলী খেত প্লাবিত হবে। তলিয়ে যেতে পারে নীচু অঞ্চলের ঘরবাড়ি। জানতে চাইলে কখানো গোপালগঞ্জ আবার কখনো ওয়াহেদ সাহেবের কাছ থেকে তারা খালে মাছ চাষ করার অনুমতি পেয়েছেন বলে দাবি করে থাকেন।

ফরিদপুর গ্রামের জিন্নাত আলী জানান, গত ১৯ জুন রাত ৮টার দিকে তিনি এক বছর আগে ফরিদপুর ব্রীজের নিকটবর্তী নিজের ঘেরের বাসার পাশের রাস্তায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় আলম ঢালী,
বাদশা, শাজাহান ঢালী, আরশাদ, হবি , রাজু, সেকেন্দার, হোগলা গ্রামের আরশাদ আলীসহ কয়েকজন তাকে ধরে ব্রীজের পশ্চিম পাশে নিয়ে যেয়ে নেট পাটা সরানোর অভিযোগে ব্যাপক মারপিট করে। পরে তাকে পারুলগাছায় আওয়ামী লীগের অফিসে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় মারপিট করে চোর হিসেবে পুলিশে দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় উপপরিদর্শক নিয়াজ মোহাম্মদ খান ও সহকারি উপপরিদর্শক আবু বক্কর তাকে কালিগঞ্জ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে মাথায় কয়েটি সেলাই দিয়ে থানা লকআপে নিয়ে আটক রাখেন। পরদিন সকালে ২৬ হাজার টাকার বিনিময়ে নিয়াজ মোহাম্মদ খান তাকে মুক্তি দেন। এরপরপরই তাকে শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ২৪ জুন তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। আলম বাহিনীর ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

শুক্রবার দুপুরে এলাকায় গেলে কোমরপুর ও বন্দকাটি পানখালি পাড়–ইপাড়ার শৈলন্দ্রনাথ মণ্ডল, ভোলানাথ মণ্ডল, হরেন মণ্ডল, নরেন মণ্ডল,

জিতেন মণ্ডলসহ কয়েকজন জানান, তারা বংশপরম্পরায় পুটিমারা খালে মাছ ধরে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। গত বছরের এপ্রিল মাসে কোমরপুর মোড়ে বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর দেবনাথের নেতৃত্বে আলম ঢালী, বিষ্ণুপুর ইউপি চেয়ারম্যানের ভাগ্নে ফিরোজ লস্কর, ফিরোজ মোড়ল, আব্দুস সবুর, মাসুম, কামরুলসহ কয়েকজন কোমরপুর নামকস্থানে খালের উপর আড়াআড়ি নেটপাটা দিয়ে মাছ চাষ শুরু করে। আপত্তি করায় তাদেরকে নানাভাবে হুমকি ধামকি দেওয়া হয়। কিঙ্কর খাল থেকে শ্যালো মেশিনে ঘেরে পানি তোলার জন্য ইচ্ছামত চাঁদার টাকা নিয়ে থাকেন। বর্তমানে যে বর্ষা শুরু হয়েছে তাতে নেটপাটা সরানো না হলে বিলের পানি খাল দিয়ে সরতে না পেরে ফসল ক্ষেত, চিংড়ি ঘেরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে।

শ্রীরামপুর গ্রামের লিটন গাজী ও মিজানুর রহমান জানান, বৃষ্টির পানি বাড়লে নেটপাটা তুলে পানি সরানোকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসি ও কিঙ্কর গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে যেকোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে।

জানতে চাইলে বিষ্ণপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আলম ঢালী খাল দখল করার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা অস্বীকার না করেই বলেন, জগবেড়ে থেকে আমিন শেখের দীর্ঘ পর্যন্ত সাপখালি খালের কয়েকটি স্থানে গোপালগঞ্জ এলাকার কয়েকজন ও তাদের এলাকার দলীয় ছেলেরা নেটপাটা বসিয়ে মাছ চাষ করে আসছে। জিন্নাত নামে ফরিদপুরের এক ব্যক্তিকে খালে মাছ ধরার অভিযোগে গণধোলাই দেয়। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হলে তারা বিষয়টি মীমাংসা করে নেওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর দেবনাথ জানান, তিনি বিষ্ণুপুর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রিয়াজউদ্দিনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে স্থানীয় পানখালি জেলেদের একাংশের সঙ্গে কথা বলে গত বছর কোমরপুর নামকস্থানে পুটিমারা খালে নেটপাটা দিয়ে মাছচাষ শুরু করেন। চলতি আষাড় মাসে তিনি পাটা অপসারনের সিদ্ধান্ত নিলেও সিরাজুল মেম্বর ও তার লোকজনদের বাধার মুখে তার সরাতে পারছেন না।

কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক নিয়াজ মোহাম্মদ খানের সঙ্গে শুক্রবার বিকেল সোয়া ৬টায় তার মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।

কালিগঞ্জ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহম্মেদ মাসুমের সঙ্গে তার ০১৭৭৮-৩৯০৩০০ নম্বর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার অফিস সূত্রে জানা গেছে তিনি ছুটিতে বাড়ি গেছেন।

(আরকে/এসপি/জুলাই ২৭, ২০১৮)