চৌধুরী আবদুল হান্নান


এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সম্প্রতি এক সম্মেলনে বলেছেন-“ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর জন্য যা অশনি সংকেত।” (সমকাল ১৫-৭-১৮) সাহস আছে বটে! তবে প্রশ্ন হলো, এতো সাহস তিনি কীভাবে সঞ্চয় করলেন?

সমাজকল্যানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, “অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঠুঁটো জগন্নাথে পরিনত হয়েছে। আর্থিক খাতের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।” (সমকাল ২৬-৬-১৮)। জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় তিনি আরও বলেন- প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন ব্যাংক মালিকরা। অথচ এই ব্যাংকে চলছে অবাধে লুটপাট, ঋণ খেলাপি আর অর্থ পাচারের মহোৎসব।

আমাদের অর্থমন্ত্রী ইতিপূর্বে স্বীকার করেছেন-ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে দলীয় বিবেচনায় লোক নিয়োগ করা ঠিক হয়নি, আমরা পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছি। এতদিনে ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং স্বাধীন সংস্থাটির প্রধানের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার দায়ভার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ওপর অনেকাংশে বর্তায়, তাই এ নিয়ে যতক্ষন চুপ থাকা যায়, কম বলা যায় ততই তাঁর জন্য মঙ্গল।

২০১৬ সালের মার্চ মাসে জনাব ফজলে কবির একাদশ গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরের মাসে “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নরের কাছে প্রত্যাশা” শিরোনামে সমকাল পত্রিকায় আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল ( ২১-৪-১৬)। কিন্তু ইতিমধ্যে সে প্রত্যাশাগুলো হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করে এবং বহুবিধ দায়িত্বের মধ্যে একটি বড় দায়িত্ব হলো দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। স্বাধীন সংস্থাটির স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা নেই, পরিবেশও নেই। তাছাড়া অর্থমন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বর্তমানে সংস্থাটি নখদন্তহীন, নিধিরাম সরদারে পরিনত হয়েছে এবং গভর্নর নিজেও যেন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বসেছেন।

ব্যাংক মালিকদের দাবির মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ মতামত/বিশ্লেষণ ব্যতিরেকেই গত এপ্রিলে সব ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক নগত জমার হার ( যা মুদ্রা নীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার) শতকরা এক ভাগ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ অত্যন্ত সম্মানের লোভনীয়ও। পৃথিবীর অনেক দেশের রাজ্য প্রধানের পদবিও গভর্নর। কি সুন্দর রাজকীয় নাম! প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে চাকুরি শেষে যদি এমন একটি পদ জুটে যায় আর তা যতদিন ধরে রাখা যায় মন্দ কী?

কেবল মর্যাদার আসনে আসীন থাকলেই তো চলে না, কিছু ভালো কাজও করে দেখাতে হয়। বর্তমানে কারও অজানা নয় যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতা এখন চরমে।

গত ১৮ ফেব্রয়ারি সমকাল প্রত্রিকায় “শুরুপাপে লঘুদন্ড” শিরোনামে প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপককে ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত হংয়ার পরও তাকে চাকুরি থেকে অপসারণ করা হয়নি। আত্মসাতকৃত অর্থের পরিমান বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে নৈতিকতার। সততা, বিশ্বাস মানদন্ডে যারা উত্তীর্ন নয়, তারা ব্যাংকের জন্য বিপজ্জনক। জনাব ফজলে কবির এ বিষয়ে কী বলবেন? এখন প্রশ্ন হলো-একজন অসৎ, অবিশ্বাসীকে দিয়ে কীভাবে সততা শিক্ষা দেবেন, “এথিক্স ইন ব্যাংকিং”(Ethics in banking) বিষয়ে ব্যাংকারদের সবক দেবেন?

পচন যখন মাথায়, রক্ষা করবে কে? ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “রিজার্ভ চুরির” ঘটনা এক মাসেরও বেশি গোপন রেখে তারা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে মহানিরাপত্তায় রক্ষিত সোনার ওজনে ও পরিমানে গরমিলের অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে তা নতুন করে তাদের কাঠগড়ায় দাড় করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে সোনার মান যাচাই বাচাইকারী বেচারা স্বর্ণকার বা অন্য কারো ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা হবে না, তা হলফ করে বলা যাবে না।

বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠাননের শীর্ষ নির্বাহীর ইচ্ছা বা তার একক নির্দেশে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়, অভিজ্ঞদের অংশ গ্রহণের সুযোগ কম। অধীনেরা যতই বিজ্ঞ, অভিজ্ঞই হোক না কেনো, তারা তোষামোদেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাই গভর্নর এ সকল ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না।

আমরা স্বাধীনচেতা, নির্ভীক মানুষ চাই। যিনি পদ আঁকড়ে থাকবেন না, নীতির প্রশ্নে আপোষহীন, প্রযোজনে পদত্যাগ করবেন। কিন্তু গভর্নর নিয়োগে কোনো নীতিমালা নেই, যোগ্যতা যাচাই না করে ব্যক্তি বা দলীয় পছন্দেই নিয়োগ। তবে দলীয় লাভ হতে পারে কিন্তু জাতীয় লাভ নয়।

গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের একটি প্যানেল তৈরী করার জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করা যায় এবং সেভাবে গঠিত প্যানেল থেকে একজনকে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি অথবা সরকার প্রধান। ব্যাংক ব্যবস্থাকে ক্রম অবনতি থেকে উদ্ধার করতে সুরক্ষা দিতে এ বিষয়ে ভাবতে হবে এখনই।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।