রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার সুজলা সুফলা বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের আলোচিত গ্রামের নাম বেজুয়া। এ গ্রামে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। কৃষি ও মাছ চাষই গ্রামবাসির প্রধান পেশা। এ গ্রামে মিশ্র চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছেন সন্তোষ মণ্ডলের ছেলে গোবিন্দ মণ্ডল। তার দেখাদেখি অনেকেই এ চাষে ঝুঁকছেন।

সন্তোষ মণ্ডল পৈতৃক সূত্রে প্রায় দেড় বিঘা জমি পান। দু’ মেয়ে ও এক ছেলে ছিল তার। একমাত্র ছেলে গোবিন্দ মণ্ডল সংসারের অভাব ঘোচাতে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে আর লেখাপড়া করতে পারেননি। মৌমাছি পালন আর দিনমজুর খেটে চলতো তাদের সংসার। ১৯৯১ সালে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানাধীন ভদ্রদিয়া গ্রামের অনিতা মণ্ডলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সে সময় তাদের মাটির বসত ঘর, রান্না ঘর ও একটি গোয়াল ঘর ছিল। গোয়ালে একটি গাভী ছিল। শ্বশুর বাড়ির এলাকায় ধানের সঙ্গে মাছ ও বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হন গোবিন্দ মণ্ডল। ইতিমধ্যেই গৌতম ও শুভ নামে দু’ ছেলে হয়েছে তাদের। তাদের পড়াশুনার জন্য গরুর দুধ বিক্রিই ছিল মা অনিতা মণ্ডলের একমাত্র ভরসা। কারণ তাদের বাবার আয়ে পড়াশুনা করানা কঠিণ হয়ে পড়তো।

২০০৮ সালে কাকা কালিপদ মণ্ডলের (তহশীলদার) কাছ থেকে চার বিঘা জমি ২৪ হাজার টাকায় লীজ নিয়ে তাতে পুকুর কেটে মাছ ও ধান চাষের পাশাপাশি সবজি চাষ শুরু করেন গোবিন্দ মণ্ডল। এ কাজে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করতেন তার স্ত্রী অনিতা। কয়েক বছর যেতে না যেতেই এ চাষকে আরো বেশি লাভজনক করতে তিনি ওই জমির চারিধারে বেড়া দিয়ে ভেড়িবাঁধের উপর কখনো ঢেঁড়স, কখনো বা সিম, কখনো বা বেগুন লাগান। পুকুরের ভিতরে বাঁশের চটা ও তার দিয়ে মাচা তৈরি করে তাতে উচ্ছে, ধুঁন্দুল, বরবটি, পুঁইশাক, সিম, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, শসাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সবজি চাষ করেন। শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে মিষ্টি পানি সেচ দিয়ে তাতে রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, সিলভার কাপ, গ্রাসকাপ, বাটাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে থাকেন। পৈতৃক এক বিঘা জমিতে থাকা একটি পুকুর তাকে এ মাছ চাষে সহায়তা করে থাকে।

সরেজমিনে শুক্রবার সকালে বেজুয়া গ্রামে গেলে নিজের মিশ্র চাষের জমিতে কাজ করতে করতে এ প্রতিবেদককে জানান তার সফলতার কথা। গ্রীষ্মের ধান কেটে নেওয়ার পর বর্ষার জন্য বিরি-১০ ধানের পাতা ফেলেছেন। আরো দু’ সপ্তাহ পরে ঘেরের জল কমিয়ে তাতে ধান চাষ করবেন। বর্তমানে পুকুরে রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, সিলভার কাপ, গ্রাসকাপ, বাটাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রয়েছে। জমির চারপাশ জুড়ে ভেড়িবাঁধের উপর ঢেঁড়স গাছ, পুঁই শাক, সিম গাছ, মিষ্টি কুমড়া , লাউ ও শশা গাছ লাগিয়েছেন। ঘের জুড়ে বাঁশের চটা ও তার দিয়ে উপরের অংশ ছেয়ে ফেলা হয়েছে।

এখন ধুন্দুল, ঢেঁড়স ও শশা উৎপাদন হচ্ছে। পরিমানে কম হলেও দাম বেশি। এবার বাজারে মাছের দাম বেশি থাকায় লাভ ও ভাল হচ্ছে। দু’ বছরে লাগানো মাচান সংস্কার করতে তাকে ১২ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। আরো ভাল মাচান করতে হলে আট থেকে ১০ হাজার টাকা লাগতো। তবে গত বছর সিম গাছে ভাইরাস লাগায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে জানালেন গোবিন্দ মণ্ডল। উপজেলা ও জেলা কৃষি কর্মকর্তারা তাকে সার্বিক পরামশর্ দিয়ে থাকেন। তবে খারাপ বীজের কারণে কোন কোন সময় উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। বছরে দু’ বার ধান, মাছ ও সবজি চাষ থেকে খরচ বাদ দিয়ে বর্তমানে লীজের ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর এক লাখের ও বেশি টাকা লাভ থাকে বলে জানান তিনি। তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের মাছের ঘেরে মিশ্র বা সমন্বিত চাষ শুরু করেছেন।

মিশ্র চাষ করে গোবিন্দ মণ্ডল চার কক্ষ বিশিষ্ঠ পাকা বসতঘর, একটি রান্না ঘর, একটি গোয়ালঘর, কাঠ ঘর বানানোর পাশাপাশি পাকা বাথরুম বানিয়েছেন। বসিয়েছেন সুপেয় জলের জন্য টিউবওয়েল। গোয়ালে তার দু’টি এড়ে গরু, একটি দুগ্ধবতী গাভী ও একটি বাছুর। গত বছর একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলেও তা পরিশোধ হয়েছে। ব্যাংকে কিছু টাকা জমাও করেছেন। বড় ছেলে গৌতম কালিগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি উন্নয়ন সমিতি নামে একটি ঋণদান সংস্থায় মাঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে।

ছোট ছেলে শুভ বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তারা পড়াশুনা ও কাজের ফাঁকে বাবা ও মাকে সহায়তা করে থাকে। ইচ্ছা করলে কঠোর পরিশ্রম করে কৃষিকাজেও ভাগ্যের পরিবর্তণ করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন গোবিন্দ মণ্ডল।

কালিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ ফজলুল হক মনি জানান, ব্লক সুপার ভাইজার ছাড়াও তার অফিসের কর্মকর্তারা গোবিন্দ মণ্ডলকে সব ধরণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আগামিতে গোবিন্দ মণ্ডলের মত অন্যরা এগিয়ে এলে কৃষি ও মাছ চাষে বেজুয়া একটি মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।# সাতক্ষীরা প্রতিনিধি।

(আরকে/এসপি/জুলাই ৩১, ২০১৮)