চৌধুরী আবদুল হান্নান


সময়কাল ৯০ দশকের মাঝামাঝি। সোনালী ব্যাংকের প্রশাসন বিভাগটি প্রধান কার্যালয়ের ৩৫টির মত বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার বলে মনে করা হয়। এ বিভাগটির বগুবিধ কাজের মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ দেশব্যপী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রান্সফার ও পোস্টিং। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নীতিমালা অনুসরণ করতে দেখা যায় না বড় একটা। তদবির আর ব্যক্তিগত যোগাযোগই এখানে প্রধান।

একই কর্মস্থলে ৩ বছরের অধিক অবস্থানরত কর্মরতদের অন্যত্র বদলিকরণ যাদের কাজ তারাই এ বিভাগে বহাল তবিয়তে আছেন ১০/১৫ বছর। তারা কখনো মূল ব্যাংকিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না বা শাখা ব্যাংকিং করেননি। ব্যাংকিং বিষয়ে তারা অন্যদের পরামর্শ দেয়ার মত পরিপক্ক তো ননই প্রাথমিক জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। অথচ তারাই “বিশেষজ্ঞ পরামর্শ” দিয়ে থাকেন এবং সার্ভিস রুলের ব্যাখ্যাও নিজেদের সুবিধামত দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন।

প্রকৃতপক্ষে যারা তৃনমূলে বা শাখা পর্যায়ে কাজ করেন তারাই ব্যাংকের আসল সৈনিক এবং তাদের সাপোর্ট দেয়ার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রণকারী কার্যালয়ের কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীত দেখা যায়।

অপরদিকে, শাখা পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদেও সময়মত পদোন্নতি হওয়ার নজীর বিরল কিন্তু প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত যারা তাদের সময়মত পদোন্নতি নিশ্চিত।

অবাক বিস্ময়- ২২ হাজার কর্মীবাহিনী ১২০০ শাখা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী দেশের সর্ব বৃহৎ ব্যাংকটির যারা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রেণের দায়িত্বে রয়েছেন তারা কারা?

সোনালী ব্যাংকের প্রশাসন বিভাগের কায়কারবার দেখলে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার দু-একটি লাইন মনে পড়বেই।

-“এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা।”

-“পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপারিশ ছাড়া।”

অপরদিকে যারা “চালাক চতুর” তারা প্রধান কার্যালয়ে পোস্টিং পেতে মরিয়া, তাতে সুবিধা অনেক। ঝামেলা বিহীন, বড় স্যারদের কাছাকাছি থাকা, সময়মত পদোন্নতি পাওয়া ইত্যাদি। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নজরে এলো-প্রধান কার্যালয়ে লোক গিজগিজ করছে অথচ শাখাগুলোতে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব। তিনি ক্ষুব্ধ হলেন, রেগে গেলেন।

সংস্কারে হাত দেবেন, প্রাথমিক উদ্যোগ:

(ক) প্রধান কার্যালয়ের অর্ধেক লোকবল সরাতে হবে,
(খ) শাখা ব্যাংকিং এর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকদের বেছে বেছে প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসতে হবে।

প্রথম পদক্ষেপেই তাৎক্ষনিক ছাড়পত্রের শর্ত দিয়ে এজিএম ও ডিজিএম পদমর্যাদার ২৫ জনের মত একটি লম্বা বদলি আদেশ জারী করা হলো। আতংকে কাঁপলো ব্যাংকপাড়া, আতংক সংক্রমিত হলো, ডালপালা বিস্তার করলো- কেউ আর প্রধান কার্যালয়ে থাকতে পারবে না। বদলি আদেশের বিরুদ্ধে ওরা জোটবদ্ধ হলো। আন্দোলন দ্রুত প্রবল হতে লাগলো, এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের হাতে আর ক্ষমতা রইলো না। ক্ষমতা চলে গেলে বাইরের ক্ষমতাবানদের হাতে। তারপর যা হবার তাই হলো-উদ্যোগ ভেস্তে গেল। এবারও গোষ্ঠী-স্বার্থ বহাল রইলো, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নিকট এ এক অন্য রকম লজ্জা।

এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে এলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (পরবর্তী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর)। কেউ বললো-কত দেখলাম, কত এলো-কত গেলো। মনে হলো, তিনি হোম-ওয়ার্ক করেই ব্যাংকের দায়িত্ব গ্রহণ করতে এসেছেন। বিভাগওয়ারী কর্মকর্তাদের তালিকা চেক করে যারপর নেই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন তালিকায় সত্য গোপনের মত প্রতারণাও রয়েছে।

অবস্থা বেগাতিক, অসুখটা গুরুতর। তবে তিনি কৌশলে ও বিচক্ষনতার সাথে তিন মাসের মধ্যে প্রথম উদ্যোগেই ৫ বছরের অধিক সময় শিকড় গেড়ে থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে বিদায় করতে সক্ষম হলেন। তিনি একটি অপশন রেখেছিলেন-যে যেখানে যেতে চায় সেখানেই তাকে দেয়া হবে, তবে শর্ত হলো প্রধান কার্যালয় ছাড়তে হবে।

দীর্ঘদিনের জমাট বাঁধা সমস্যা ক্রমশ দূর করে সোনালী ব্যাংকের ম্যানপাওয়ার ম্যানেজমেন্টকে এক স্বর্ণযুগের দ্বার প্রান্তে এনে দিলেন ব্যাংক ও আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা সোনালী ব্যাংকেরই সবচেয়ে বেশি, বিনা লাভে ৪০টির মত সার্ভিস দেয় সোনালী ব্যাংক। ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য ব্যাংকের মত গ্রাহকদের ঘরে ঘরে ধর্না দিতে হয় না ব্যাংটির। কেবল প্রয়োজন কাউন্টার সার্ভিস একটু উন্নত করা। অতীতের সকল বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাড়িয়েছে সোনালী ব্যাংক এবং এগিয়ে যাচ্ছে গণমানুষের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক ব্যাংটি।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার