রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষপর্যায়ের জনপ্রতিনিধির ইচ্ছায় দু’ সহোদরকে থানা লকআপে আটক রেখে প্রতিপক্ষ এক ব্যবসায়ির বাড়িঘর ভাঙচুর , লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ভাঙচুর ও লুটপাটে বাধা দেওয়ায় একই পরিবারের সাতজনকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে।

শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে দু’পুর দুটো পর্যন্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাধঘাটা গ্রামের পশু হাসপাতালের পাশে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

আহতদের মধ্যে বাধঘাটা গ্রামের নুর আলী গাজীর ছেলে আবুল কালাম, তার ভাই আব্দুস সালাম, আব্দুস সাত্তার ও সালামের স্ত্রী সাদিকুন্নাহারকে শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

শ্যামনগর সদরের বাধঘাটা গ্রামে পশু হাসপাতালের সামনের সালাম এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী আবুল কালাম জানান, দু’ বছর আগে বাধঘাটা গ্রামের স্ত্রী সাবিনা খাতুন ও ছেলে এমদাদুল হকের কাছে কোবালামুলে বাধঘাটা মৌজার এসএ ১২ ও ১৪ খতিয়ানের ২০৩ দাগে সাড়ে ২২ শতক জমি হস্তান্তর করেন। হস্তান্তরকৃত জমির মধ্যে গত এপ্রিল মাসে তিনি ছয় শতক জমি সাবিনা ও এমদাদুলের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকায় কেনেন। পরে সেখানে টিনের চাল দিয়ে ছয়টি পাকা বসত ঘর ও একটি রান্না ঘর নির্মাণ করেন। নিঃস্বত্ব হয়ে যাওয়া বড় ভাই আব্দুস সবুরের সঙ্গে আপোষ বন্টননামা সূত্রে ওই জমি তাদের বলে দাবি করে আসছিলেন আব্দুল বারি, তার ভাই আবু সাঈদসহ অন্যরা।

এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেওয়ায় সবুরের স্ত্রী সাবিনা খাতুন বাদি হয়ে আব্দুল বারী, আবু সাঈদ, আব্দুর রাজ্জাক ও ইমান আলীর নামে গত ১৭ মে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ১৪৫ ধারায় মামলা দায়ের করেন। আদালত আগামি ১৯ আগষ্টের মধ্যে দখল সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য শ্যামনগর উপজেলা সহকারি ভূমি কমিশনারকে নির্দেশ দেন। একইসাথে শ্যামনগর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

আবুল কালাম অভিযোগ করে বলেন, জমির দখল প্রমাণ করতে আব্দুল বারি ও তার ভাই আবু সাঈদ তার কেনা জমি দখলে নিতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক শীর্ষপর্যায়ের নেতা ও জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে পুলিশকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ওই জমি দখলের পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক রাজ কিশোর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আটজন পুলিশ ও ১৪/১৫ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে তাদের বাড়িতে যায়। এ সময় তাকে ও ভাই সালামকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে ওসি স্যার ডাকছেন বলে দু’ ভাইয়ের হাতে হ্যতকড়া পরিয়ে থানা লকআপে আটক রাখেন রাজ কিশোর চক্রবর্তী। দু’পুর দু’ টোর দিকে ওই জনপ্রতিনিধির কথামত জমিতে যাব না এমন মুচলেকা নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাড়ির উঠানে আসার পরপরই সাত্তার ও তাদের দু’ ভাইয়ের উপর হামলা চালানো হয়।

তিনি আরো জানান, তাদের দু’ভাইকে ধরে থানা লকআপে আটক রাখার পর বারি ও ভাই সাঈদের নেতৃত্বে তাদের ছয়টি বসত ঘরে চার লক্ষাধিক টাকার টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, কাঠের ও স্টীলের আসবাবপত্র, রান্না সামগ্রী ভাঙচুর ও দেড় লাখ টাকাসহ সোনার গহনা ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়। পক্ষাঘাত আক্রান্ত বাবা নুর আলী গাজী ও মা জহুরা বেগমকে ওটেনে হিচড়ে ঘর থেকে উঠানে নামনো হয়। হামলাকারিরা হাতুড়ি, শাবল, গাইতি দিয়ে তাদের চারটি ঘরের দেয়াল ভুঙচুর করে টিনের চালগুলো নিয়ে চলে যায়।

সালামের ব্যবহৃত বসতঘরে ও রান্না ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুটপাটে বাধা দেওয়ায় ভাই সালামের স্ত্রী সাকিবুন্নাহারকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ছাড়া কলেজপড়–য়া মেয়ে সুমাইয়া ইয়াসমিন ও দশম শ্রেণীর ছাত্রী ফাতেমা খাতুন, আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী রাশিদা বেগমকে লাঞ্ছিত করা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের তিন ভাই ও সাকিবুন্নাহারকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। হাসপাতালে ভর্তি না থাকলে তাদেরকে খোলা আকাশের নীচে বাস করতে হতো বলে জানান আবুল কালাম। সন্ধ্যায় তাদের ভাগ্নে জবের আলীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।

এদিকে আব্দুল বারি কালামের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জুম্মার নামাজ শেষে দু’পুর দু’ টোর দিকে কালাম, সালামসহ কয়েকজন বহিরাগত তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। হামলায় তার মা সায়েরা, মেয়ে রিভা ও ছেলে সাকিব আহত হয়। তাদেরকে শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

জানতে চাইলে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক রাজ কিশোর চক্রবর্তী তার বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, বিরোধ থামাতে শুক্রবার সাড়ে ৮টার দিকে তিনি বাধঘাটা থেকে আবুল কালাম, তার ভাই আব্দুস সালাম ও তাদের প্রতিপক্ষ আব্দুল বারির গৃহকর্মী মুজিবর রহমানকে ধরে থানায় আটক রাখেন। স্থানীয় সাংসদ এসএম জগলুল হায়দারের কথামত তাদের তিনজনের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর কালাম, সালাম ও বহিরাগত চার সন্ত্রাসীর হামলায় বারির ছেলে, মেয়ে ও মা গুরুতর আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে এ ঘটনায় শুক্রবার বিকেলে থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্যামনগরের সাংসদ এসএম জগলুল হায়দারের সঙ্গে তার ০১৭১২০০৯৮০৪ মোবাইল নম্বরে যোগযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাটি তিনি শুনেছেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(আরকে/এসপি/আগস্ট ১০, ২০১৮)