রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আর্থিক সুবিধা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষপর্যায়ের জনপ্রতিনিধির কথামত দু’ সহোদরকে থানা লকআপে আটক রেখে পুলিশের উপস্থিতিতে এক ব্যবসায়ির বাড়িঘর ভাঙচুর , লুটপাট,অগ্নিসংযোগ ও ১০ জন আহত হওয়ার ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। শনিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাধঘাটা গ্রামের আব্দুল বারি তরফদার ও একই গ্রামের সিমেন্ট ব্যবসায়ি আবুল কালাম বাদি হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ শ্যামনগর হাসপাতাল থেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় আটককৃত জাবের হোসেনকে গ্রেফতার দেখিয়ে শনিবার আদালতে পাঠিয়েছে।

গ্রেফতারকৃত জাবের আলী সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরের আব্দুল জব্বারের ছেলে।

দু’ বছর আগে শ্যামনগর উপজেলার বাধঘাটা গ্রামের সাবিনা খাতুন ও তার ছেলে এমদাদুল হকের কাছে কোবালামুলে লিখে দেওয়া ২২ শতক জমির মধ্যে ছয় শতক জমি গত এপ্রিল মাসে কিনে নেন একই গ্রামের সিমেন্ট ব্যবসায়ি আবুল কালাম। সেখানে টিনের চাল দিয়ে ছয়টি পাকা বসত ঘর ও একটি রান্না ঘর নির্মাণ করে শান্তিপূর্ন দখলে ছিলেন আবুল কালাম। নিঃস্বত্ব হয়ে যাওয়া বড় ভাই আব্দুস সবুরের সঙ্গে আপোষ বন্টননামা সূত্রে ওই জমি তাদের বলে দাবি করে ভাই আব্দুল বারি, তার ভাই আবু সাঈদসহ অন্যরা আদালতের ১৪৫ ধারার মামলার নোটিশ উপক্ষো করে ওই জমি দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

এরই অংশ হিসেবে জমির দখল প্রমাণ করতে আব্দুল বারি ও তার ভাই আবু সাঈদ তার কেনা জমি দখলে নিতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক শীর্ষপর্যায়ের নেতা ও জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে পুলিশকে মোটা অংকের টাকা দেয়। ওই জনপ্রতিনিধির কথামত শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক রাজ কিশোর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা আবুল কালামের জমি দখলে যায়। এ সময় জমি দখলে বাধা দেওয়ায় রাজকিশোর চক্রবর্তী আবুল কালাম ও তার ভাই সালামকে হাতকড়া পরিয়ে থানা লকআপে ছয় ঘন্টা আটক রেখে সাংসদ এসএম জগলুল হায়দারের কথামত ওই জমিতে যাবে না এমন মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। তারা মুক্তি পেয়ে বাড়ি গেলে পুলিশের উপস্থিতিতে বারি ও ভাই সাঈদের নেতৃত্বে তাদের ছয়টি বসত ঘরে চার লক্ষাধিক টাকার টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, কাঠের ও স্টীলের আসবাবপত্র, রান্না সামগ্রী ভাঙচুর ও দেড় লাখ টাকাসহ সোনার গহনা ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র লুটপাট করা হয় বলে জানা যায়। পক্ষাঘাত আক্রান্ত বাবা নুর আলী গাজী ও মা জহুরা বেগমকে ওটেনে হিচড়ে ঘর থেকে উঠানে নামনো হয়। হামলাকারিরা হাতুড়ি, শাবল, গাইতি দিয়ে তাদের চারটি ঘরের দেয়াল ভুঙচুর করে টিনের চালগুলো নিয়ে চলে যায়। সালামের ব্যবহৃত বসতঘরে ও রান্না ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

লুটপাটে বাধা দেওয়ায় ভাই সালামের স্ত্রী সাকিবুন্নাহারকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ছাড়া কলেজপড়ুয়া মেয়ে সুমাইয়া ইয়াসমিন ও দশম শ্রেণীর ছাত্রী ফাতেমা খাতুন, আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী রাশিদা বেগমকে লাঞ্ছিত করা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের তিন ভাইকে দ্বিতীয় দফায় মারপিট করা হয়। স্থানীয়রা তিন ভাই ও সাকিবুন্নাহারকে উদ্ধার করে শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সন্ধ্যায় হাসপাতালে তাদেরকে দেখতে আসা ভাগ্নে জাবের আলীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। যদিও আব্দুল বারি হামলার কথা অস্বীকার করে বলেন জুম্মার নামাজ শেষে দু’পুর দু’ টোর দিকে কালাম, সালামসহ কয়েকজন বহিরাগত তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। হামলায় তার মা সায়েরা, মেয়ে রিভা ও ছেলে সাকিব আহত হয়। তাদেরকে শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

তবে শনিবার সকালে বাধঘাটা গ্রামে গেলে প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ি সামছুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, আব্দুল করিম, জামিলা খাতুনসহ কয়েকজন জানান, পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে যেভাবে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটলো তা যে কোন বর্বরতাকে হার মানায়। হামলাকারিদের মামলা পুলিশ আগে রেকর্ড করে তাদের ভূমিকাকে আবাপরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

একইভাবে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক রাজ কিশোর চক্রবর্তী তার ও পুলিশের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, এলাকার শান্তিরক্ষায় বিরোধ থামাতে শুক্রবার সাড়ে ৮টার দিকে তিনি বাধঘাটা থেকে আবুল কালাম, তার ভাই আব্দুস সালাম ও তাদের প্রতিপক্ষ আব্দুল বারির গৃহকর্মী মুজিবর রহমানকে ধরে থানায় আটক রাখেন।

স্থানীয় সাংসদ এসএম জগলুল হায়দারের কথামত তাদের তিনজনের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর কালাম, সালাম ও বহিরাগত চার সন্ত্রাসীর হামলায় বারির ছেলে, মেয়ে ও মা গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে আব্দুল বারি বাদি হয়ে ১১ জনের বিরুদ্ধে ও আবুল কালাম বাদি হয়ে ৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় জাবের আলী নামের একজনকে গ্রেফতার করে শনিবার আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

সাংসদ এসএম জগলুল হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, আব্দুল বারি ও আবুল কালামের মধ্যে বিরোধ নিয়ে তার কিছু জানা ছিল না। যদি কেউ তার নাম ভাঙায় সে দায় তার নয়। তবে খবর পেয়ে পুলিশকে যথাযথ ভূমিকা রাখার জন্য বলা হয়েছে।

(আরকে/এসপি/আগস্ট ১১, ২০১৮)