শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুরে আবার শুরু হয়েছে পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি। ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে নড়িয়া উপজেলা সদরের মূল অবকাঠামোগুলো। সম্প্রতি আকষ্মিক ভাঙ্গনের কবলে পরে পানির তোড়ে ভেসে যায় প্রায় ২৯ ব্যক্তি। সেখান থেকে ১৯ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ৮ দিনেও খোঁজ মিলেনি ৯ জনের। ৭ দিন পর ১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এদিকে আগামী শুষ্ক মৌসুমরে আগে প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাধ নির্মান সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে পািন উন্নয়ন বোর্ড।

চলতি বছরের ২ জানুয়ারী জাজিরার কুন্ডেরচর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মার ডান তীর প্রতিরক্ষার জন্য স্থায়ী বাধ নির্মানে সরকার ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। কিন্তু নানা জটিলতায় সুষ্ক মৌসুমে বাধ নির্মানের কাজ শুরু না করায় এ বছরও ভাঙ্গন শুরু হয়েছে ব্যাপক এলাকা নিয়ে। বর্তমান ভাঙ্গন কবলিত চার কিলোমিটার এলাকায় জরুরী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করার জন্য ২০ কোটি টাকার আবেদন করা হলে অনুমোদন পাওয়া গেছে মাত্র ৭৩০ মিটার ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় বালু ভর্তি জি,ও ব্যাগ ফেলার জন্য ৫ কোটি টাকা। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল । এদিকে সময় মত মূল প্রকল্পের কাজ না করায় ক্ষোভ জমেছে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। তাদের দাবী বালুর বস্তা নয়, জরুরী ভিত্তিতে তীর রক্ষা বাধ নির্মানের মূল প্রকল্পের কাজ শুরু করার।

স্থানীয়রা জানান, জুন মাসের শেষ দিক থেকে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর, কুন্ডেরচর ইউনিয়ন এবং নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়ন, ঘড়িসার ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌর এলাকায় পদ্মা নদীর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের ফলে গোটা এলাকায় এক হাজারেরও অধিক পরিবার তাদের বসত বাড়িসহ সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে নড়িয়া বাজার, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, খাদ্য গুদাম, পৌরসভা ভবন, নড়িয়া বালিকা বিদ্যালয়, নড়িয়া বিহারীলাল উচ্চ বিদ্যালয়, নড়িয়া সরকারি কলেজ, ডজন খানেক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক, মুলফৎগঞ্জ বাজার, বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ হাজার হাজার জনবসতি ।

গত ৭ জুলাই দুপুর দুইটার দিকে হঠাৎ করে নড়িয়ার পদ্মা তীরে অবস্থিত সাধুর বাজারে আকষ্মিক ভাঙ্গনে দেবে যায় বাজারের একটি বৃহৎ অংশ। এসময় অন্তত ৮-১০ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন কাজে বাজারে অবস্থানরত অন্তত ২৯ ব্যক্তি ভাঙ্গনের কবলে পরে পানির তোড়ে ভেসে যায়। স্থানীয়রা ইঞ্জিন চালিত নৌকার সহায়তায় ১৯ জনকে উদ্ধার করেন। নিখোঁজ থেকে যায় ১০ জন। নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন, নড়িয়া উপজেলার উত্তর কেদারপুর গ্রামের শাহজাহান বেপারী (৭০), মজিবুর রহমান ছৈয়াল (৪৫), গোপী বাছার (৫৫), কেদারপুর গ্রামের নাসির বয়াতী (১৮), মোশারফ চোকদার (৪৬), চাকধ গ্রামের নাসির হাওলাদার (৩৫), বাড়ইপাড়া গ্রামের কামাল উদ্দিন ছৈয়াল (৬২), দক্ষিণ চাকধ গ্রামের অন্তু মগদম (১৫), মোক্তারের চর গ্রামের আব্দুর রশিদ হাওলাদার (৩৬) ও বরিশাল জেলার নাজিরপুর বরইবুনিয়া গ্রামের আল আমিন (২৭)।

দুর্ঘটনার ৭ দিন পর সোমবার চাঁদপুর জেলার হাইমচর এলাকায় মেঘনার চরে পাওয়া যায় আল আমিনের গলিত লাশ। স্বজনরা তাকে সনাক্ত করে নিজ বাড়ি বরিশানে নিয়ে যান। আল আমিন একটি ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতো শরীয়তপুরে। ওই দিন সাধুর বাজারে গিয়েছিলেন তার চাকুরী সংক্রান্ত কাজে। এখনো নিখোঁজদের ফিরে পেতে নদীর পাড়ে আসা স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পদ্মা পাড়ের বাতাস।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে ঘটনাস্থলের আশেপাশে ও পদ্মা নদীর উজানে বিশাল এলাকা নিয়ে নৌ- পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা অনুসন্ধান কাজ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু কাউকেই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভোর ৫ টায় একই এলাকায় নোঙর করা তিনটি লঞ্চ নদী ভাঙ্গনের কবলে পরে নদী গর্ভে বিলীন হয়। সেদিনও ১৬ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়। কয়েকদিন পর দুই জনের মরদেহ পাওয়া গেলেও এখনো নিখোঁজ রয়ে গেছে ১৪ জন।

দিন রাত ভাঙ্গনের কবলে পরে দিশেহারা এলাকাবাসী। তাদের স্বপ্নের সব স্থাপনা শিকার হচ্ছে পদ্মার নির্দয় ছোবলের। কোটি টাকা মূল্যের একেকটা ইমারত চোখের সামনেই বিলীন হচ্ছে নদী গর্ভে। এখনো যারা তাদের বসত ঘরটি নিয়ে কোন রকমে টিকে রয়েছেন রাক্ষুসী পদ্মার মুখের সামনে, তাদের দাবী সামান্য বালুর বস্তা নয়, তারা চান অচিরেই যেন বাস্তবায়িত হয় স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের কাজ।

নিখোঁজ শাহজাহান বেপারীর মেয়ে শাহনাজ বেগম বলেন, আমার বাবা একজন রিকশা চালক ছিলেন। তিনি বাজারের দোকানপাট সরানোর কাজে সহায়তা করতে এসে নদী ভাঙ্গনের কবলে পরে নিখোঁজ হয়ে যান। তার কোনো সন্ধান পাইনি। আমার একটি বোন ও একটি ভাই প্রতিবন্ধি। আমার বাবাকে খুঁজে না পেলে কিভাবে আমাদের সংসার চলবে, কে আমার দুটি প্রতিবন্ধি ভাই-বোনের মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দিবে?

নিখোঁজ মজিবুর ছৈয়ালের স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী গাছ কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। ভাঙ্গন এলাকার গাছ কেনার জন্য সে সাধুরবাজার এসেছিলেন। কিন্তু লঞ্চঘাট এলাকা ধ্বসে পড়ার পর থেকে আমার স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না ।

ভাঙ্গনকবলিত এলাকার বাসিন্দা শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, বছরের প্রথম বৈঠকে একনেকের সভায় পদ্মার ডানতীর রক্ষার জন্য ১ হাজার ১ শত কোটি অনুমোদন দেয়া হলেও একটি মহলের অবহেলার কারনে গত শুস্ক মৌসুমে বাধ নির্মানের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এখন জরুরী প্রতিরক্ষামূলক কাজে যে জি,ও ব্যাগ ফেলানো হচ্ছে তা অপরিকল্পিত। এতে কোন উপকার হচ্ছেনা। নদী যেভাবে ভাংছে তাতে আমাদের নড়িয়া সদরের অস্তিত্ব আগামী এক মাসের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।

নড়িয়া পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম বাবু রাড়ি বলেন, এ বছরের ভাঙ্গনে আমার পৌরসভার ২ ও ৪ নং ওয়ার্ডের ৮০ শতাংশ পরবিারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ৭৭৩টি বাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফলতির কারনে আজ আমরা আমাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছি। এখনো যদি স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মামের কাজ শুরু না করা হয় তাহলে নড়িয়া বাজারসহ অন্তত ২০টি স্কুল কলেজ, পৌর ভবন, উপজেলা কমপ্লেক্স, হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম সব কিছু বিলীন হয়ে এই উপজেলার মানচিত্র থেকে নড়িয়া উপজেলা শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জি,ও ব্যাগ ফেলে জরুরী প্রতিরক্ষার কাজ প্রায় শেষের দিকে। ৮ দশমিক ৯ কিলোমিটার এলাকার স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মমের জন্য আগামী ২৬ আগষ্ট বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলনা শীপ ইয়ার্ড দরপত্র দাখিল করবে। দরপত্র মূল্যায়নের পর ক্যাবিনেট কমিটিতে দরপত্র অনুমোদন দেয়া হলে সেপ্টেম্বরের পরে কার্যাদেশ প্রদান করা সম্ভব হবে। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আগামী শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস নাগাদ স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের কাজ শুরু করা যেতে পারে। আরো আগে কেন প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের কাজ শুরু করা সম্ভব হলোনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা জানান, আইনগত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারনেই গত শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু করা যায়নি।

(কেএনআই/এসপি/আগস্ট ১৪, ২০১৮)