রুপক মুখার্জি, লোহাগড়া (নড়াইল) : “জমি আছে ঘর নেই যার, তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ”, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতি ঘর ১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। প্রকল্পের ঘর নির্মাণে প্ল্যান, ডিজাইন, নির্মাণ সামগ্রীসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুণগত মান বজায় রাখা হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে নিম্ন মানের সামগ্রী। 

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউএনও এর সভাপতিত্বে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম)এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে “যার জমি আছে ঘর নাই, তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ” নীতিমালা অনুযায়ী গঠিত কমিটি (পিআইসি) দ্বারা নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও রকিবুল ইসলাম কালু ও রাইজুল নামের দুইজন ঠিকাদার এসব কাজ তড়িঘড়ি করে শেষ করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে লোহাগড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪১টি এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৪৭টি ঘর নির্মাণের তালিকা করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষে প্রতিটি ঘর নির্মানের জন্য ১ লাখ টাকা করে মোট ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করে সরকার। এলাকার দুস্থ-অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা নারী, শারীরিক পতিবন্ধী, উপার্জনে অক্ষম, অতি বৃদ্ধ এমনকি পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য নেই এমন ব্যক্তিরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। নীতিমালা অনুযায়ী সুবিধাভোগীর থাকতে হবে ১ থেকে ১০ শতাংশ জমি। লোহাগড়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

ঘরপ্রাপ্ত অসহায় মানুষগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের সম্পূর্ণ টাকা ব্যয় করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ টাকা ব্যয়ে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হত তাহলে অসহায়, দুস্থ ও পুণর্বাসিত ব্যক্তিদের স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হত। উপকারভোগীরা আরও জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিনামুল্যে পাওয়া ঘরের মেঝেতে আমাদেরকে মাটি ভরাট করতে বাধ্য করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা। এ জন্য ধার-দেনা করে গুনতে হয়েছে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। মাথাগোজার একমাত্র গৃহটি যাতে সুন্দর হয়, সে জন্য কর্তব্যরত কর্তাদের কথামত ঘর নির্মানকারী শ্রমিকদের নিয়মিত দুই বেলা এমনকি কখনও কখনও তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে উপার্জনে অক্ষম পরিবারদের।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত নকসাঁ ও প্রাক্কলন থেকে জানা গেছে, প্রতিটি ঘরের মেঝে ১৫০ মি.মি. বালি দেওয়ার পর ডাবল লেয়ার পলিথিনের ওপর ঢালাই দিতে হবে।

সরেজমিনে গিয়ে তার কোন মিল পাওয়া যায়নি। প্রতিটি দরজা ও জানালায় রং করার কথা উল্লেখ থাকলেও তা করা হয় নি।

এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আজিম উদ্দিন বলেন, সরকার যে টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তা দিয়ে নকসাঁ ও প্রাক্কলন মোতাবেক ঘর তৈরি করা সম্ভব না। তবে যদি কোন ঘরে অনিয়ম হয়ে থাকে,সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে ।

উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের উপকারভোগী পতো বিবির নামে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের অধীন ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত বছর ৩০ জুনের মধ্যে ওই অর্থ বছরের কাজ শেষ করার কথা থকলেও পতো বিবির ঘরের মেঝে আজও পাকা হয়নি। এ বিষয়ে তাঁর (উপকারভোগী পতো বিবি) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘর নির্মাণের সময় নির্মান শ্রমিকরা আমাকে ঘরের মেঝেতে মাটি দিয়ে ভরাট করতে বলে। আমি বুড়ো (বৃদ্ধ) মানুষ, বয়স্ক ভাতা ও ভিক্ষুকের চাল যা পাই তাই দিয়ে কোন রকম জীবন চালাই। আমার পক্ষে মাটি ভরাট করা সম্ভব না।

তখন মিস্ত্রিরা জানায়, যদি মাটি ভরাট না কর তাহলে ঘরের কাজ বন্ধ থাকবে। উপায় না পেয়ে কর্জ (ঋণ) করে কিশেন (লেবার) দিয়ে মাটি ভরাট করি। এ কাজে শ্রমিকদের ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু আজও আমার ঘরের মেঝে পাকা হয় নি।

২০১৭-১৮ অর্থ বছরে লোহাগড়ার দিঘলিয়া ইউনিয়নের মৃত ইউছুপ শেখের ছেলে প্রতিবন্ধী রহমত শেখের নামে একই প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ হয়। রহমতের মা দিলারা বেগম জানান, ঘর নির্মানের ঠিকাদার আমাকে দিয়ে মেঝেতে মাটি ভরাট এবং বাথরুমের (ল্যাট্রিন) গর্ত খুড়তে বাধ্য করে। আমি ১০জন শ্রমিক দিয়ে মাটি ভরাট ও গর্ত খুড়ি। তাতে বিল দিতে হয়েছে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া নির্মান শ্রমিকদের তিন বেলা খাবার দিতে হয়েছে। খাবার দিতে না চাইলে টিনের মিস্ত্রিরা চাল ফুটো (ছিদ্র) করে দেওয়ার ভয় দেখালে বাধ্য হয়ে তাদের খেতে দেই।

ইতনা ইউনিয়নের লংকারচর গ্রামের উপকারভোগী আমেনা বেগমের নাতী ইসহাক বলেন, আমেনা বেগমের বাড়ি রাস্তা থেকে একটু দুরে হওয়ায় ঘর নির্মানের ঠিকাদারের লোকজন কাঠ, টিনসহ অন্যান্য উপকরণ রাস্তার উপর রেখে যায় এবং আমাদের জানায় এসব মাল তোমাদের নিজ খরচে বাড়িতে নিতে হবে। উপায় না দেখে ১ হাজার ২০০ টাকা ভ্যান ভাড়া দিয়ে সেগুলি বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে ৮০০ টাকা লেবার খরচ দিয়ে মেঝেতে মাটি দেই। এমনকি ঘর পাকা করতে শ্রমিকদের বালি কম পড়ে। সেই বালিও আমরা ৭০০ টাকা দিয়ে কিনে দিলেই তবে ঘরের কাজ শেষ হয়।

এসব অনিয়মের বিষয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুকুল কুমার মৈত্র বলেন, আমি খোজ খবর নিয়েছি। সরকারের বরাদ্দকৃত ১ লাখ টাকায় ঘরের নির্মান কাজ শেষ করা কঠিন।

যে সমস্ত ঘরের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে তা দ্রুত সমাপ্ত করা হবে।

(আরএম/এসপি/আগস্ট ১৪, ২০১৮)