স্টাফ রিপোর্টার : সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় গত এক দশকে বাংলাদেশের বিদুৎ উৎপাদন বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে। প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে এখাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে সরকার। ফলে একের পর এক দেশি-বিদেশি কোম্পানি নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করছেত। এরই ধারাবাহিকতায় বরগুনায় ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছে আইসোটেক গ্রুপ। 

এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইসোটেক ইলেকট্রোফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার ছোট নিশানবাড়ীয়ায় নির্মাণ করতে যাচ্ছে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প। আগামী ২০২২ সালের শুরু থেকেই উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে আইসোটেক। উৎপাদন শুরুর পর জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে নূন্যতম ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

চলতি বছরের ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় সংক্রান্ত (পার্চেস এগ্রিমেন্ট ও ইমপ্লিমেন্টেশন) চুক্তি সম্পন্ন করেছে আইসোটেক। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চীনের ‘পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড’ ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের সহযোগি প্রতিষ্ঠান ‘আইসোটেক ইলেট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড’। প্রকল্পটি ‘বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’ নামে পরিচালিত হবে। মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা (৫৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। মোট ৩০০ একর জমির উপর নির্মিতব্য এই প্লান্ট থেকে চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দর ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৭ টাকা (প্রতিটন কয়লার দর ১২০ ডলার হিসেবে)। তবে কয়লার দরের উপর সামঞ্জস্য রেখে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সর্বনিম্ন দাম পড়বে ৪ টাকা।

নির্মাণাধীন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দূরত্ব টেংরাগীরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল (ফাতরার চর) থেকে ন্যূনতম ৬.৩৮ কিলোমিটার এবং সুন্দরবন থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে দুই কিলোমিটার এবং সুন্দরবন (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ইতোমধ্যে বন বিভাগের অনাপত্তিপত্র পেয়েছে আইসোটেক। এছাড়া নির্মানাধীন প্রকল্প এলাকায় সরকারি কোনো খাস জমি নেই মর্মে ভূমি অফিস থেকে এবং প্রকল্প এলাকায় বন বিভাগেরও কোনো জমি নেই বলে বনবিভাগ ছাড়পত্র দিয়েছে।

ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থানগত সার্টিফিকেট পাওয়ায় জমি অধিগ্রহণ, জমি ক্রয়, বাঁধ নির্মাণ, মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এসব কাজ শেষে দেওয়া হবে স্থাপনা নির্মাণের ছাড়পত্র।

আইসোটেক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মঈনুল আলম বলেন, সরকারের সকল নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কারণ, সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার প্লান্টটির নির্মাণ কাজ ৪৫ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, বিআইডাব্লিউটিএ ও স্থানীয় প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে সহোযেগিতা করে যাচ্ছে। এজন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

তিনি আরো বলেন, প্রকল্পটি সফলভাবে সমাপ্ত করতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণও সাহায্য করছে। সবার সাহায্য সহযোগিতা না পেলে এত বড় কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করছি, সবার সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ন্যাশনাল গ্রিডে ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবো।

দেশে বিদ্যুতের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে মঈনুল আলম বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এই অর্জন ধরে রেখে উন্নত দেশের কাতারে যেতে আমাদের অনেক বেশি উন্নয়নমুখী হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ স্লোগানকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনশত সাত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও অত্র অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল পিডিবি। তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি।

সেখানে পুরোপুরি ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে আইসোটেকের ক্ষেত্রে। তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

মো. মঈনুল আলম বলেন, যেহেতু প্রকল্পটি বৈদেশিক অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে সেহেতু নিয়ম নীতির ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, আমাদের পার্টনার ‘পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড’ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান। তারা ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে দক্ষতার সঙ্গে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তারা বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

পাওয়ার প্লান্টটি নির্মাণ হলে এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে জানান আইসোটেক গ্রুপের মিডিয়া এডভাইজার সিনিয়র ফটো সাংবাদিক ফিরোজ চৌধুরী। তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে সাড়ে তিন হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া এ অঞ্চলের জনগণের কথা চিন্তা করে প্রকল্প এলাকায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। যেহেতু এলাকার পানি লবনাক্ত সেহেতু গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয়দের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যেই প্রকল্প এলাকায় নানামুখী সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে আইসোটেক গ্রুপ।

উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৮১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৮৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ হাজার ৬৫৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১১৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। বর্তমানে মোট ১৩ হাজার ৭৭১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। আর এ কেন্দ্রগুলো ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এছাড়া ৫ হাজার ৯২ মেগাওয়াটের ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন। যেগুলো ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে।

(কেসিটি/এসপি/আগস্ট ১৮, ২০১৮)