বরগুনা প্রতিনিধি : সামনে ঈদ তাই সূর্যোদয়ের পর থেকেই তালতলীর রাখাইন পল্লী তাঁতের ছন্দময় খট খট শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। ছন্দে ছন্দে কাপড় বোনা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এ শব্দ বলে দেয় মন্দা কাটিয়ে পুরনো জৌলুস ফিরে পেয়েছে তাঁতপল্লী। পুরনো হস্তচালিত তাঁতের পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে সেমি-অটোমেটিক তাঁত। প্রযুক্তির আধুনিকায়নে সাহায্য করেছে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা।

এখানকার রাখাইন নারীদের তাঁত কাপড় বোনার ঐতিহ্য প্রায় ২০০ বছরের। তারা পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী সারাবছরই তাঁতে লুঙ্গি, গামছা, থামি, গায়ের চাদর, বিছানার চাদর, ব্যাগ ও কম্বলসহ নানা ধরনের কাপড় বুনেন। এ সব কাপড়ে ঝলমলে রঙের ব্যবহারে ফুটিয়ে তোলা হয় লতা-পাতা, ফুল, পাখি ও জীব-জন্তুসহ প্রকৃতির দৃশ্য। বর্ণিল এ কাপড়গুলোর চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। ফ্যাশন মোটিফ হিসেবে এর কদরও অনেক দিনের।
তাঁতশিল্পী খেনাচিন (৪০) বলেন, সুতায় আমরা কমপক্ষে ৮ ধরনের রঙের ব্যবহার করি, এ সব রঙ কৃত্রিম নয়, প্রকৃতি থেকে নেওয়া। সুতায় রঙ করতে আমরা শাল, বকুলসহ বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকল ব্যবহার করি। এতে রঙ টেকসই হয়। বাজারের অন্য যে কোনো কাপড়ের তুলনায় আমাদের কাপড়ের রঙ আলাদা। এ সব পণ্যের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রতিটি গায়ের চাদর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, লুঙ্গি ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা, ব্যাগ ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করছি।
রাখাইন নারীরা সারাবছর তাঁতের কাজ করলেও বিভিন্ন পার্বণ, বিশেষ করে ঈদ ও শীতের মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে কাপড় বোনা শুরু করেন। তখন সুতায় রঙ করা, তাঁতে কাপড় বোনা, ব্যাগ তৈরি, স্থানীয় বাজারে বিক্রি এবং বাণিজ্যিক চালানে ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। এ সব কাপড় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়।
তাঁতশিল্পী খেনাচিন আরও জানান, এখানে উৎপাদিত কাপড় বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও কুয়াকাটার রাখাইন মার্কেটে বাজারজাত করা হয়। এ সব জায়গায় বেড়াতে আসা পর্যটক তাদের প্রধান ক্রেতা। এভাবে কৃষিকাজের পাশাপাশি তাঁত আবারও তালতলীর রাখাইনদের অন্যতম জীবিকা হয়ে উঠছে।
তালতলীতে সেমি-অটো তাঁত প্রযুক্তির দ্বার উন্মোচন করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ)। সংস্থাটি ৫০টি রাখাইন পরিবারকে একটি করে সেমি-অটো তাঁতযন্ত্র দিয়েছে। জার্মান সরকারের অর্থায়নে জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের (জিআইজেড) সহযোগিতায় কোস্টাল লাইভলিহুডস অ্যাডাপ্টেশন প্রজেক্টের আওতায় এ সব তাঁত দেওয়া হয়। এ ছাড়া নারীদের কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে তরঙ্গ নামের আরেকটি বেসরকারি সংস্থা।
তালতলীর রাখাইন সমাজকল্যাণ সংস্থা সূত্রে জানা যায়, নবগঠিত তালতলী উপজেলায় ১৩টি পাড়ায় ২৮০টি রাখাইন পরিবার বাস করছে। রাখাইন পাড়াগুলোর মধ্যে তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, মনুখেপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, সওদাগরপাড়া, কবিরাজপাড়া, তালুকদারপাড়া, তাঁতীপাড়া, লাউপাড়া ও অঙ্কুজানপাড়ায় দুই শতাধিক হস্তচালিত ও কোমর তাঁত রয়েছে।
ছাতনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অংতেন তালুকদার বলেন, এক সময় এমন প্রথা চালু ছিল যে, কোনো রাখাইন মেয়ে যদি তাঁত বুনতে না জানত, তাহলে তার বিয়েই হতো না। এখন রাখাইন নারীরা সেমি-অটো তাঁতযন্ত্র পাওয়ার পাশাপাশি তা চালনার প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন।
তাঁতশিল্পী এমেনমু (৪০) বলেন, সেমি-অটো তাঁত একদিকে কষ্ট দূর করেছে, অন্যদিকে উৎপাদনও বাড়িয়েছে। কারণ সেমি-অটো তাঁতের মাধ্যমে একজন তাঁতকর্মী দিনে ৩টি কাপড় বুনতে পারেন।
আরেক তাঁতশিল্পী মং তাহান বাবু বলেন, পুরাতন হস্তচালিত ও কোমর তাঁতযন্ত্র ব্যবহার করে ৩ দিন সময় লেগে যায় একটি লুঙ্গির কাপড় বুনতে। এ ছাড়া কাপড় বোনার সূতার মূল্য বৃদ্ধি ও দুষ্প্রপ্যতার কারণে সাধারণ তাঁতীরা খুব একটা লাভের মুখ দেখতে পায় না।
রাখাইন সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্য সচিব খে মংলা বলেন, এই সেমি-অটো তাঁতের মাধ্যমে একদিনেই ৩টি কাপড় বোনা যায়। এ মুহূর্তে তালতলীতে রাখাইন তাঁতীদের জন্য সেমি-অটোমেটিক তাঁত বুনন প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন এবং তাঁত ও সুতা কেনার জন্য তাঁতীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান জরুরি। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রাখাইনদের পারিবারিক তাঁত, লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
আরডিএফের সহকারী পরিচালক ও কোস্টাল লাইভলিহুডস অ্যাডাপ্টেশন প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর মো. এনামুল হক বলেন, সেমি-অটো তাঁতযন্ত্র রাখাইন তাঁতীদের আয় আগের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি করেছে। এ যন্ত্র ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে উৎপাদনের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
তিনি মনে করেন, তাঁতশিল্পের নতুনতর এ যাত্রা রাখাইন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখবে।
(এমএইচ/এএস/জুলাই ১৫, ২০১৪)