মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : মো. নেছার উদ্দিন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক। প্রায় ২০ বছর একই উপজেলায় চাকুরী করায় শিক্ষা অফিসকে তিনি দূর্নীতির আখড়ায় পরিনত করেছেন। বছর বছর শিক্ষা কর্মকর্তা বদলী হলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় নেছার উদ্দিন বহাল তবিয়তে থাকায় উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে তিনি এখন এক মূর্তিমান আতংক। তার অনিয়ম ও ঘুষ কেলেংকারিতে অতিষ্ট হয়ে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রনালয়, দুদক, মাউশির মহা পরিচালক বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগ প্রেরন করা হলেও তার বিরুদ্ধে আনীত দূর্নীতির দৃশ্যমান কোন তদন্ত হয় না। এ কারনে একই পদে থেকে তার অনিয়মই এখন নিয়মে পরিনত হয়েছে।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন কক্ষে উপজেলা পরিষদের ৫৩ তম সভায় কমিটির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব তালুকদার বলেন, একই কর্মস্থলে ১৫/২০ বছর থাকায় নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুদকের শুনানী চলাকালে সরাসরি অভিযোগ করা হয়। কিন্তু সে বদলী হচ্ছে না। সভায় তাকে বদলী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সে সভার ৫০ দিন অতিবাহিত হলেও এখনও বহাল তবিয়তে অফিস সহকারী নেছার উদ্দিন। উল্টো তার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছে সেই শিক্ষকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে নেছার উদ্দিন।

তবে পটুয়াখালী জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও কলাপাড়া উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে। তার তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে দোষী প্রমানিত হলে শুধু বদলী না তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অফিস সহকারী নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলাপাড়ার ৩৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সরকারি পাঠ্য বই বিনা মূল্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌছে দেয়ার জন্য বই প্রতি ০.১৫ টাকা হারে প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। অথচ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বই পরিবহনের খরচ পায়নি। উল্টো বই আনা পরিবহনের খরচের নামে অবৈধভাবে প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০০/১০০০ টাকা তাকে দিতে হয়।

প্রতি কিস্তির উপবৃত্তির টাকা প্রদানে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দুই হাজার টাকা করে তাকে দিতে হয়। এছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন এমপিও, টাইমস্কেল, ইনডেক্স ডিলিট-সংশোধনী অনলাইনে করতে হলে তাকে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিও করার অনলাইন আবেদনে শুধু পোষ্ট ভিউ করার জন্য প্রত্যেক পদে ১০ হাজার টাকা করে উৎকোচ দিতে হয়।

প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তথ্য জমার সময় পাঁচশ থেকে ১৫’শ টাকা, সেকায়েপের উপবৃত্তির কাগজপত্র জমার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতি দুই হাজার টাকা, মনিটরিং ফরম জমাদানে পাঁচশ টাকা, উপবৃত্তির আপিল ফরম জমাদানে দুই হাজার টাকা, ্ইএমআইএস ও ব্যানবেইজ বার্ষিক জরিপ হার্ড কপি জমাদানে ছয়শ টাকা, বিদ্যালয়ের মাসিক বেতনের রিটার্ন ফরমে দুইশ টাকা, সেকায়েপ কর্তৃক এসিটি শিক্ষক পাওয়ার আবেদন ও চুক্তি অগ্রায়নে প্রতিষ্ঠান প্রতি আট হাজার টাকা, উপবৃত্তির টিউশন ফি, আইসিটি গ্রান্ট, পিটিএ গ্রান্ট, বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন কল্পে সেকায়েপ কর্তৃক আর্থিক অনুদানের আবেদন অগ্রায়নে ও সকল আর্থিক কর্মকান্ডে তাকে ১০ভাগ হারে ঘুস দিতে হয়। টাকা ছাড়া এ কাজ হয়না বলে তারা অভিযোগে উল্লেখ করেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অভিযোগ, অনুত্তোলিত উপবৃত্তির টাকা ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজসে শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাক্ষর জাল করে উত্তোলন করে থাকেন যা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা জানেন না।

একই বছরের ৩০ জানুয়ারি লালুয়া এসকেজেবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুনায়েত হোসেন দুদক কমিশনার ডা. মো. নাসির উদ্দিন বরাবরে অভিযোগে উল্লেখ করেন, নিয়োগ পরবর্তী বেতন-ভাতা অনলাইনে অগ্রায়র করার দেয়ার নাম করে তিন কিস্তিতে ৪৬ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহন করে নেছার উদ্দিন। কিন্তু বেতন বর্তমান পদে এমপিও ভূক্ত না হওয়ায় ঘুষের টাকা ফেরত চাইলে তিনি টাকা দিকে অস্বীকার করেন।

একই বছরের ৮ আগষ্ট কলাপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর হলদি বাড়িয়া ইবতেদায়ী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মোসলেহ উদ্দিন অভিযোগ করেন তিনি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হলেও তাকে না জানিয়ে এ নেছার উদ্দিন একই মাদরাসার সহকারী শিক্ষক নুর সাইদকে প্রধান শিক্ষক করে অন্য শিক্ষকদের ভূয়া নাম দেখিয়ে মাদরাসার ফাইল পাঠায়। টাকার বিনিময়ে নেছার উদ্দিন পুরাতন শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নতুন শিক্ষকদের নাম তালিকাভূক্ত করেছেনে বলে তার অভিযোগ।

২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ৩২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে অফিস সহকারী নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অভিযোগে উল্লেখ করেন, প্রতিবছর এফএসপি-৩ ফরম জমা দেওয়ার সময় প্রতি বিদ্যালয় হতে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা উৎকোচ না দিলে ফরম জমা নেন না। টিউশন ফি উত্তোলনে ছাড়পত্র নেওয়ার সময় মোটা অংকের টাকা দিতে হয়। এ অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন লালুয়া এসকেজেবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুনায়েত হোসেন।
শিক্ষকদের পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য টি কিউ আই প্রকল্পের অধীনে সি পি ডি প্রশিক্ষণের শিক্ষক প্রেরণের তালিকা করার সময় তাকে টাকা দিতে হয়। এ অভিযোগ করেন ধানখালী গাজী মান্নান বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. এরশাদুল আলম, লালুয়া জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলাম হোসেন, লালুয়া এসকেজেবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মো. হানিফ খান।

এছাড়া অফিসের সরকারি গুরুত্বপূর্ন কাগজপত্র বাসায় নিয়ে শিক্ষকদের বাসায় ডেকে টাকার বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য করেন শিক্ষকদের। তার বাসায় শিক্ষকদের ঘুষ গ্রহনের ভিডিও চিত্র এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও শিক্ষদের মোবাইলে মোবাইলে ভাইরাল হলেও ডন্ট কেয়ার ভাব নেছার উদ্দিনের। উল্টো তার প্রশ্ন কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি, এগুলো মিথ্যা। আর ভাইরাল ঘুষ গ্রহনের ভিডিও তিনি দেখেন নি বলে জানান।

নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত

অফিস সহকারী নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ কলাপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদ হোসেন কলাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। (যার স্মারক নং ইউএসইও/কলা/পটু/৫১/২০১৭/১৭১)। তদন্ত রিপোর্টে তিঁনি উল্লেখ করেন, উত্তর হলদিবাড়িয়া (স্বতন্ত্র) ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগকালীন সময়ে সভাপতি মোসলেহউদ্দীন আহম্মেদের সাক্ষর জাল করে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগটি তদন্তে প্রমানিত হয়েছে। এছাড়া নুর সাইদ, সহকারী শিক্ষক(শরীর চর্চা) উমিপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় কর্মরত এমপিওভূক্ত শিক্ষক থাকা সত্বেও উত্তর হলদিবাড়িয়া (স্বতন্ত্র) ইবতেদায়ী মাদরাসায় কর্মরত প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাগজপত্র সভাপতির শিক্ষক জাল করে জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠিয়েছেন। এই তদন্তে নেছারউদ্দিন জড়িত থাকলেও তার নাম তদন্তে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি কলাপাড়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের গনশুনানীকালে নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে শিক্ষকরা। সে সময়ে এক মাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিলেও গত ১৯ মাসেও নেছার উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে কলাপাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী নেছার উদ্দিন বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। তাছাড়া উপজেলা পরিষদের সভায় তাকে বদলীর সিদ্ধান্তের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান।

(এমকেআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৮)