স্টাফ রিপোর্টার : বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী বলেন, ‘মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ফুটওভার ব্রিজ করেছি, মানুষ ব্যবহার করে না। ঢাকা সিটিতে বেরিয়ে দেখুন কেউ নিয়ম-কানুন মানে না। সব বেপরোয়া ড্রাইভারের জন্য হচ্ছে তাতো নয়। বেপরোয়া পথচারীও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। পথচারীরা কোনো নিয়ম মানতে চায় না। বর্ষায় জলজট, যানজট, জনজট আপনি কীভাবে রাস্তায় শৃঙ্খলা রাখবেন।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না করে মেট্রোরেল করে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করে লাভ নেই। এখানে সমন্বয়ের প্রচণ্ড ঘাটতি। যেজন্য আমি অনেক এজেন্ডা হাতে নিয়েছি, আমরা কাজ করবো হাইলি অ্যাম্বিসাস, সেখানে আমাদের ঘটতি নেই। কিন্তু আমাদের ইপ্লিমেন্টশন প্রসেস ইজ ভেরি স্লো অ্যান্ড লিমিটেড। সেজন্য অনেক কাজ করা যায়নি।’

বাংলাদেশে কয়েকশ ইজিবাইক কারখানা আছে জানিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বলেন, ‘উৎসমুখ যেটা সেটা বন্ধ করতে পারিনি। চিঠি দিয়েছি, কথা বলেছি, মিটিংয়ে ডেকেছি, প্রতিনিধি এসেছেন কিন্তু বাস্তবায়ন জিরো। আমি মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করি, যে এরকম কেন হয়?’

তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতে টেলিভিশনে দুর্ঘটনায় ক্যাজুয়ালটি দেখে আজ সকালে আমি পত্রিকা পড়িনি। কারণ সকাল বেলা মনটা খারাপ হয়ে যায়। এগুলোতে মনের ওপরও তো একটা প্রতিক্রিয়া হয়। মন্ত্রী হলেও আমি তো মানুষ। এগুলো কী আমাকে আলোড়িত করে না? এসবের প্রভাব কী আমার জীবনে নেই?’

‘প্রতিদিন এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন? এখন নতুন উপদ্রপ ব্যাটারিচালিত রিকশা। এই নগরীতেও বেশকিছু চলে। মোটরসাইকেল তো এখন মূর্তিমান আতঙ্ক।’

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি সিরিয়াস ও সিনসিয়ার, তারও লোকবল কম। এছাড়া এখানে সাইকোলজিক্যাল কিছু প্রবলেম আছে। পুলিশ আবার হাইওয়ে পুলিশ। ইদানীং দায়িত্বটা সবাই ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশ যেহেতু আছে জেলা পুলিশ মনে করে এটা তো আমাদের দায়িত্ব নয়।’

বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে সমৃদ্ধিতে প্রতিযোগিতায় আছে তার সঙ্গে ঢাকা শহরের চিত্র এটা যে কি ভয়ংকর? আমি বারবার বলি কোন সমাধান হয় না, রংচং দিয়ে ঠিক রাখ, তাকানো যায় না। এত গরিব গরিব চেহারা, ছাল-বাকল উঠে গেঠে, মা-বাবার দোয়া, আল্লাহর নামে চলিলাম, চলিতে চলিতে পদচারীর গায়ের উপর- এই তো অবস্থা হচ্ছে।’

মহাসড়কে ইজিবাইক বন্ধ না হওয়ার পেছনে জনপ্রতিনিধিদের হাত রয়েছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘হুক-অ্যাঙ্গেল-বাম্পার ৯০ শতাংশ বন্ধ হয়েছে, ইজিবাইক গাড়িগুলো ২২টি সড়কে পুরোপুরি বন্ধ করতে সাকসেসফুল হয়েছি। অন্যান্য স্থানে সরানো যেত আমরা যদি জনপ্রতিনিধিরা, আমাদের দেশের অনেক পলিটিশিয়ান এসবের পেছনে আছে। পেছন থেকে মদদ দেন অনেক জনপ্রতিনিধি।’

‘মাঝে মাঝে বলি আমাদের পলিটিক্সটা যদি পুরোপুরি ঠিক হত, তাহলে বাংলাদেশের সব সেক্টর ঠিক রাখা যেত। এখানে আমাদের মূল সমস্যা। আপনি দেখুন ঢাকা শহরে পুলিশকে নিয়ে দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর সবাই এখন হেলমেট পরে চলে। এখন দুইজনই হেলমেট পরে। যখন দেখবেন মোটরসাইকেলে যাত্রী তিনজন, কারোরই হেলমেট নেই, এরা পলিটিশিয়ান, এরা হচ্ছে রাজনীতির লোক দে ডোন্ট কেয়ার’ বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

‘এই প্রবণতা বন্ধ করার চেষ্টা করছি- আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব যতক্ষণ আমার হাতে দায়িত্ব আছে।’

কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইনটি পুনঃবিবেচনা করা দরকার সেখানে অনেক ফাঁক-ফোঁকর আছে। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলেতে হবে। গত ২ বছরে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা কেন বাস্তবায়ন হয়নি তা পর্যালোচনা করে নির্দেশ দেওয়া উচিত।’

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘লাইসেন্সধারী চালকরা ওভারটেকসহ আইন অমান্যের কারণে দুর্ঘটনা ঘটালে ১০ বছরের জেল দেয়ার কথা বলছি আমরা। জানার পরও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে দুর্ঘটনা ঘটনানো কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া বা ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক দুর্ঘটনা ঘটালে ৩০২ ধারার মামলার বিধান রাখার জন্য বলছি আমরা। এখানে ইন্টেশন আছে, জেনে শুনেই এটা করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খসড়া সড়ক পরিবহন আইনে বলা হয়েছে, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের শাস্তি ২ বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। কিন্তু যার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তার ৬ মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। ধরা পড়লে তো ফেক লাইসেন্সধারী বলবে তার লাইসেন্স নেই। আমরা দু'টি ক্ষেত্রেই ২ বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখার দাবি জানাচ্ছি।’

সড়ক সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নিয়ে একটি অথরিটি গঠনেরও প্রস্তাব দেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, ‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে কোম্পানি করতে হবে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারার একটি কারণ প্রতিযোগিতা।’

ঢাকায় বৈধ পার্কিং স্থান নির্ধারণ, গণপরিবহনে হাইড্রোলিক দরজা, রিকশায় লুকিং গ্লাস রাখার দাবি জানান ফারুক তালুকদার।

সভায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মিজানুর রহমান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম, পুলিশের হাইওয়ে রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আতিকুল ইসলামসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৮)