সঞ্জিব দাস, গলাচিপা  (পটুয়াখালী) : গান গাওয়া ও মানুষকে গান শেখানো আমার নেশা। সঙ্গীত আমার জীবনের একটা বড় অংশ। সঙ্গীত ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। সঙ্গীতের আলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই আমার কাজ। সঙ্গীত আমার নিত্য দিনের সঙ্গী। সঙ্গীতের মাঝেই আমি বেঁচে থাকতে চাই। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমি সঙ্গীত চর্চা করে যাব। কথাগুলো এক সঙ্গীতশিল্পীর। তিনি আর কেউ নন কার্তিক চন্দ্র দাস। 

পটুয়াখালীর গলাচিপায় প্রখ্যাত প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী কার্তিক চন্দ্র দাস’র নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৌরসভার হাসপাতাল রোডের প্রয়াত অশ্বিণী কুমার দাস’র এ ছেলেটি বড় হয়ে যে এমন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার সঙ্গীতপিপাসু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুরের ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে দিবেন- পরিবারের কেউই তা কখনও কল্পনা করেন নি। বয়স তাঁর ৬৫ ছাড়িয়েছে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তিনি আসক্ত ছিলেন।

১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে তিনি একজন ভাল কন্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পটুয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় তিনি গণসঙ্গীত গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এ অবদানটুকুও কম কিসে। এসব কথা আজ শুধুই স্মৃতি। ১৯৭৩ সালে গলাচিপা শিল্পকলা একাডেমিতে শিক্ষার্থীদের গান শেখানোর মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ সঙ্গীত কারিগর হিসেবে এলাকায় সু-প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

দক্ষিণের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তিনি সু-পরিচিতি লাভ করেন। দিনে দিনে সঙ্গীত জগতের তাঁর এ সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৪ সালে খুলনা বেতার কেন্দ্র ও ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক গান গেয়ে তিনি এলাকার সুনাম অর্জন করেন।

এক সময়ে দক্ষিণের সাগর পাড়ের রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন চরে সুবিধা বঞ্ছিত শিশুদের মাঝে সঙ্গীতের আলো ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে স্যাপ বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও-তে তিনি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। বর্তমানে তিনি পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বাংলাদেশ-তুরষ্ক ফ্রেন্ডশিপ স্কুলে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তিনি উপজেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও জড়িত আছেন। যিনি শত অভাব-অনটন, হাজারো প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে গলাচিপার সাংস্কৃতিক অঙ্গণের নিভে যাওয়া দ্বীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। তিনিই দায়িত্ব নিয়েছেন পৌরসভার শিল্পকলা একাডেমির শিশু-কিশোরদের মাঝে সঙ্গীতের প্রভা ছড়িয়ে দেয়ার।

সঙ্গীতের মাধ্যমে এলাকার সঙ্গীতপ্রিয় শিক্ষার্থীদের দ্বারা শুদ্ধু সংস্কৃতি চর্চার দ্বার উম্মোচনের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। সপ্তাহে বৃহস্পতি ও শুক্রবার এ দু’দিন বসে শিল্পকলা একাডেমিতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গান শেখার আসর। কার্তিক চন্দ্র দাস জানান, বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০/৬২ জন। সামনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। আর বাংলাদেশ-তুরষ্ক ফ্রেন্ডশিপ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭০ জন।

এছাড়াও তিনি সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে সঙ্গীতানুরাগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছোট-বড় অনেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তাঁর দু’টি মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ের বিবাহ হয়েছে। ছোট মেয়ে প্রতিবন্ধী। সংসারে স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে নিয়ে বর্তমানে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে এ বয়সে কোন রকমে জীবন-যাপন করে বেঁচে আছেন তিনি।

জীবনে তিনি গান গেয়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর শিক্ষার্থীরা উপজেলা-জেলা-বিভাগ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ নিচ্ছে এবং জাতীয় পুরস্কার ছিনিয়ে আনছে। এসব শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশের নেপথ্যের নায়ক কিংবা কারিগর কার্তিক চন্দ্র দাস’র খবর এখন ক’জনই-বা রাখেন।

(এসডি/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৮)