মতিউর রহমান মুন্না, নবীগঞ্জ : দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই চিকিৎসকদের অবহেলা, ভুল চিকিৎসা ও হাসপাতালের অব্যবস্থাপনায় ঘটছে মৃত্যু ও চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আর্তমানবতার সেবার বদলে যেভাবেই হোক অর্থ আদায় এ পেশার সুনামকে জিম্মি করে ফেলছেন কিছু অসাধু চিকিৎসকরা। 

এমনই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে নবীগঞ্জে। উপজেলার আউশকান্দি বাজারে অবস্থিত অরবিট নামের একটি প্রাইভেট হসপিটালের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। জিবা নামের এক শিশু সুস্থ হওয়ার পরও অর্থের লোভে তাকে প্রেরণ করা হয়েছিল ‘উন্নত’ হসপিটালের আরেক চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু দুই চিকিৎসকের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় প্রমাণ করছে সবই ছিল তাদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল। এ ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতারনার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে একটি চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের ফুলতলী বাজার এলাকার বাসিন্দা প্রাণ কোম্পানীর শ্রমিক রুবেল মিয়া ও শিরিনা আক্তারের ৪০ দিন বয়সী শিশু ইসমত নাহার জিবা ঘনঘন হেচকি দিচ্ছিল। তাদের মনের সন্দেহ দূর করতে গত ৩১ আগস্ট সকালে আদরের শিশু সন্তান জিবাকে নিয়ে স্থানীয় আউশকান্দি বাজারের অরবিট হসপিটালের নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ এ.এইচ.এম খায়রুল বাশারের শরণাপন্ন হন তার মা শিরিন আক্তার। ৫ শ টাকা ভিজিট রেখে কিছু ঔষধ লিখে দেন এবং পরদিন শিশুর অবস্থা জানানোর জন্য পরামর্শ দেন ওই চিকিৎসক। কিন্তু পরের দিন শিশুটি আগের মতোই রয়েছে একথা জানালে ডাঃ খায়রুল বাশার শিশুটির অবস্থা আশংকাজনক বলে উল্লেখ করেন। টাকার দিকে না তাকিয়ে দ্রুত মৌলভীবাজারের মামুন হসপিটালে ভর্তি করে সেখানের ডাঃ বিশ্বজিতের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তাদের।

সেখানে গিয়ে ডাঃ বিশ্বজিতের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেয়ার জন্যও বলে দেন ওই শিশুর মাকে। আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও শিশুর প্রাণ রক্ষার্থে দ্রুত মৌলভীবাজার ছুটে যান শিশুর মা শিরিনা আক্তার। সেখানে যাওয়ার পর খোঁজে বের করেন ডাঃ বিশ্বজিতকে। এমনকি তার সাথে শিরিনা আক্তারের মোবাইল ফোন দিয়ে কথা বলেন ডাঃ খায়রুল বাশার।

পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাঃ বিশ্বজিত মোবাইল ফোনে ডাঃ খায়রুল বাশারকে জানান ‘শিশু জিবা পুরো সুস্থ আছে। কিন্তু এ সময় সম্পূর্ণ সুস্থ জিবাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন ডাঃ খায়রুল বাশার।’ সে অনুযায়ী রাতে ওই ক্লিনিকে ভর্তি করা হয় জিবাকে। মোবাইল ফোনে তাদের কথোপকথনে শিশুর মা শিরিনা আক্তারের মনে নানা সন্দেহের দানা বাঁধে। শিরিনা আক্তারের মোবাইল ফোনে অটো কল রেকর্ড এপস ইনস্টল করা ছিল। তা জানতোনা ওই দুই চিকিৎসক।

মোবাইল ফোনের কল রেকর্ডে দুই চিকিৎসকের কথোপকথনের কিছু অংশ হু-বহু তুলে ধরা হলো ঃ
ডাঃ বিশ্বজিত- ‘দোলা ভাই তোমার রোগী তো খুবই ভালা আছে। কোন সমস্যা নাই, মা কান্দতে কান্দতে শেষ’।

ডাঃ খায়রুল বাশার- ‘আমিতো জানি রোগী ভালা, ভালা ভোলা কওয়ার দরকার নাই, ভালা জীবনেও কইছ না, বল রোগী খারাপ আছে, ভর্তি করে রাখো, ভালো করে চিকিৎসা দে। ইনজেকশন টিনজেকশন মার। নাইলে শান্তি হইতো নায়।’ এসব কথা বলে হেসে হেসে ফোন রেখে দেন ডাঃ বিশ্বজিত। তাদের কথা বার্তায় সন্দেহ হওয়ায় মোবাইল ফোনের কল রেকর্ডটি শুনে প্রতারনার বিষয়টি আঁচ করতে পারেন জিবা’র মা। তাই পরদিন ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফেরে আসেন। কিন্তু জীবন রক্ষা যাদের কাজ, তাদের একজনের এমন কাজে বিষ্মিত হয়ে পরেন তিনি। মোবাইল ফোনের এমন রেকর্ড শুনে চোঁখ কপালে উঠে যায় শিরিনা আক্তারের।

এ প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে শিশু জিবার মা শিরিন বলেন, ‘আমার বাচ্চায় শুধু আতি (হেচকি) দিচ্ছিল, এ জন্য আমি বাচ্চাকে নিয়ে আউশকান্দি অরবিটের ডাঃ খায়রুল বাশার স্যারের কাছে যাই। ডাঃ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিছু ঔষধ লিখে দেন। পরে উনার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন, রাতে কল দিয়ে বাচ্চার অবস্থা জানানোর জন্য। রাতে ফোনে অবস্থা জানানোর পর তিনি মৌলভীবাজারের মামুন হসপিটালের ডাঃ বিশ্বজিতের নিকট নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

এ সময় তিনি সেখানে গিয়ে ডাঃ বিশ্বজিতকে কল দেওয়ার জন্য বলেন। রাত ১২ টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে আমার মোবাইল দিয়ে কল দেই। তারা দুই ডাক্তার কথা বলেন। এর আগেই বাচ্চাকে পরীক্ষা করেন ডাঃ বিশ্বজিত। পরে ওই প্রাইভেট হসপিটালের ভিআইপি রুমে ভর্তি করা হয়।’

ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শিরিনা আক্তার। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি আরো বলেন, ‘ডাক্তারের কাছে মানুষ যায় শান্তির জন্য, কিন্তু তিনি আমার সাথে এমন প্রতারণা করছেন যা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিনা। আমি গরিব মানুষ এতো টাকা ঋন করে নিয়ে গিয়ে হসপিটালের ভর্তি হয়ে পরে সিট কেটে বাড়ি ফিরেছি।’ ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানিয়েছি, হাটতে হাটতে স্যান্ডেল ছিড়েছি কিন্তু বিচার পাইনি।’ তিনি চিকিৎসার নামে এমন প্রতারণার সুষ্ট বিচার দাবি করেন। যাতে তার মতো অসহায় সাধারণ মানুষ প্রতারনার শিকার না হয়।

সেবার নামে চিকিৎসকের এমন মুনাফা লোভী দৃষ্টিভঙ্গিতে হতবাগ এলাকাবাসীও। এ ঘটনায় সাধারণ রোগীদের মনেও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। তারা মনে করেন, চিকিৎসকদের এমন আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়।

ওই হসপিটালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা মুশফিকা বেগম নামের এক মহিলা বলেন, ‘আমাদের শিশু-কিশোরের কোন সমস্যা হলে চিকিৎসার জন্য আমরা ডাক্তারের কাছে আসি। কিন্তু টাকার লোভে চিকিৎসকরা যদি এমন প্রতারণা করেন তাহলে চিকিৎসকের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস উঠে যাবে।’

শিফা বেগম নামের আরেক মহিলা বলেন, ‘আমি আমার শিশুকে নিয়ে এসেছি চিকিৎসা করাতে, কিন্তু এই চিকিৎসকের এমন কু-কর্ম শুনে আমি অবাক। একটা জীবিত সুস্থ শিশুকে মৃত্যুর কোলে ঢেলে দিচ্ছেন এসব ডাক্তার। এটাতো কোন চিকিৎসা কেন্দ্র হতে পারেনা, এটা পুরোই খসাইকানা।’

এ ব্যাপারে গত শুক্রবার সকালে অরবিট হসপিটালে গেলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে চেম্বার রেখে অন্যত্র অবস্থান নেন ডাঃ এএইচএম খায়রুল বাশার। প্রথমে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। পরে মোবাইলে ফোনে তার হসপিটালের পরিচালক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মহিবুর রহমান হারুনকে আনেন হসপিটালে। এক পর্যায়ে তিনি দাবী করেন ওই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন মাত্র।

এ ব্যাপারে অরবিট হসপিটালের পরিচালক মহিবুর রহমান হারুন বলেন, ‘প্রায় ১২ বছর ধরে নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ এএইচএম খায়রুল বাশার অরবিটে দায়ীত্ব পালন করে আসছেন। গত ৩১ আগষ্ট জিবা নামের ওই শিশুকে তার মা এখানে নিয়ে আসলে তাকে সিলেট প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় মৌলভীবাজার নিয়ে যান। পরবর্তিতে এ ঘটনার পর তিনি শিশুর পিতার সাথেও মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন বলেও জানান। এছাড়াও ওই চিকিৎিসক গোইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কনসালটেন্ট।

তবে এ ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে অন্য চিকিৎসকরা বলছেন, মোবাইল ফোনে যে আলাপ হয়েছে তা চিকিৎসার নৈতিকতা বিবর্জিত। এ প্রসঙ্গে সিলেট নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ কামাল আহমদ বলেন, কল রেকর্ডটি শুনে খুবই খারাপ লেগেছে। একজন চিকিৎসক এরকম মন্তব্য করতে পারেনা। অপরদিকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন নবীগঞ্জের সচেতন মহল

। তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। এসব অসাধু চিকিৎসকদের কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে তাই চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নাগরিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবার প্রতি সম্মান জানাতে এই অকাম্য অবস্থার অবসানে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান ভুক্তভোগীগণ।

(এমআরএম/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮)