রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : সরকারের কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্বেও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে তিন চাকার বাহনের(থ্রি-হুইলার) দাপট বন্ধ হয়নি। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশের টোকেন নিয়েও মহাসড়কে চলছে সিএনজি চালিত তিন চাকার অটো রিকশা। আগে চালকদের হাতে পুলিশের টোকেন থাকতো আর এখন অটোতেই লাগানো থাকে একটি স্টিকার। ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন টোকেন লাগানো থাকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এলেঙ্গা থেকে টাঙ্গাইল, বঙ্গবন্ধুসেতু, ভূঞাপুর, ঘাটাইল; টাঙ্গাইল শহর থেকে এলেঙ্গা, কালিহাতী, ভূঞাপুর, করটিয়া, তারটিয়া, বাসাইল, জামুর্কী-পাকুল্যা; মির্জাপুর থেকে গোড়াই শিল্পাঞ্চল, দেওহাটা, হাটুভাঙ্গা ইত্যাদি এলাকায় দিন-রাত সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত ভ্যান, ভটভটি, নসিমন-করিমন তথা তিন চাকার বাহন(থ্রি-হুইলার) চলাচল করছে। কখনো কখনো ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতায় থ্রি-হুইলারের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অধিকাংশ সময়ই চলাচল থাকছে অবাধ। বিশেষ করে ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এবং রাত ৮টার পর থেকে বিনা বাধায় থ্রি-হুইলার বা কম গতির বাহন যাত্রী নিয়ে মহাসড়কে চলাচল করছে।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, টাঙ্গাইল বিআরটিএ’র(বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) হিসাব মতে, জেলায় নিবন্ধিত সিএনজি চালিত অটোরিকশা রয়েছে প্রায় চার হাজার। অথচ সংশ্লিষ্টদের মতে এ সংখ্যা ন্যূনতম ২৫ হাজার। টাঙ্গাইল পৌরসভার তালিকানুযায়ী দুই শিফটে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা রয়েছে মোট তিন হাজার। অথচ ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা দেখা যায় যত্রতত্র, এর সংখ্যা ন্যূনতম ১০ হাজার বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। এসব ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাও মাঝে মাঝে মহাসড়কে ওঠে পড়ছে।

টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে এলেঙ্গাগামী সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক মজনু মিয়া(২৮), আব্দুল হালিম(২৯), রাশেদুর রহমান(৩৪); ভূঞাপুরগামী ইলিয়াস মিয়া(২৪), রফিকুল ইসলাম(২২), শামছু মিয়া(৩৮); বাসাইল, জামুর্কী-পাকুল্যা থেকে টাঙ্গাইল শহরগামী সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ আলী (২৮), নাজমুল ইসলাম(২২), শিপন(২৬); সখীপুর থেকে আসা চালক রাসেল(২২), চিত্ত রঞ্জন ঘোষ(৪০), মজনু মিয়া ওরফে মজু(৪২) সহ অনেকেই জানান, মহাসড়কের পাশ দিয়ে বা বাইপাস দিয়ে পৃথক কোন সড়ক নাই। যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে না পারলে তাদের পরিবারের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কে ওঠতে হয়। মাঝে মাঝে পুলিশ অটোরিকশা আটকালে ‘টাকা দিয়ে’ রফা করতে হয়। কখনো অটোরিকশা থানায় নিলে ফিরিয়ে আনতে ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা লাগে, তাই সড়কেই পুলিশের সাথে রফা করা ভালো বলে মনে করেন তারা।

তাছাড়া, সড়কে চলাচলের জন্য সমিতির মাধ্যমে পুলিশের মাসিক চাঁদা তো দিতেই হয়। টোকেনে চলাচলরত নম্বর বিহীন সিএনজি চালিত অটোরিকশা মহাসড়ক থেকে আটক হলে ছাড়িয়ে আনতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পুলিশকে দিতে হয়। সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালকদের গ্যাস নিতে পাম্পে যাওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। পাম্পে যাওয়ার সময়ও অনেক সময় পুলিশ বাহন আটক করে এবং টাকা ছাড়া তা ছাড়ানো যায়না।

তারটিয়া থেকে টাঙ্গাইল শহরে আসা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক হাতিলা গ্রামের আল-আমিন(২২), নাল্লা পাড়ার সাগর(২৫), ভাতকুড়ার পিন্টু মিয়া(২৫); রসুলপুর থেকে টাঙ্গাইল শহরগামী ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক আব্দুল কদ্দুস(১৮), নাইমুল আলম(৩৭); একই এলাকাগামী ব্যাটারি চালিত ভ্যান-রিকশা চালক আলম মিয়া(৩৯), ফরহাদ আলী(৪০) সহ মহাসড়কে চলাচলকারী চালকরা জানান, পৌরসভা এমনিতেই লাল ও নীল রঙের দুই শিফটে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালানোর নিয়ন বেঁধে দিয়েছে। তার উপর যদি মহাসড়ক টুকটাক ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে তাহলে সারাদিনে ১০০ টাকাও পারিশ্রমিক জুটবেনা। দু-পয়সা বেশি রোজগার করতে বাধ্য হয়ে তারা মহাসড়কে ওঠেন। তাছাড়া টাঙ্গাইল শহর থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক ব্যবহার করে নানা স্থানে যাতায়াতের সরাসরি কোন সড়ক নাই।

তারা জানান, মহাসড়কে তারাও ওঠতে চান না কিন্তু যাতায়াতের কোন আলাদা সড়ক না থাকায় বাধ্য হয়ে ওঠতে হয়।

তারা আরো জানান, কোন কোন সময় পুলিশ খুব ঝামেলা করে। পৌরসভার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও অটোর চাবি আটকে রাখেন, অটো থানায় নিয়ে যান- এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মোটা অঙ্কের টাকা খেসারত দিতে হয়। নম্বর বিহীন সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালকরা জানায়, শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে প্রতিমাসে ২০০ টাকা দিয়ে টোকেন নিয়ে তারা চলাচল করে থাকে। পুলিশের এ টোকেন আঞ্চলিক সড়কগুলোতে ১০০% কার্যকর হলেও মহাসড়কে অনেক সময়ই কার্যকর হয়না। ধরে নিয়ে মামলা দেয়া হয় বা বেশি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়।

টাঙ্গাইল জেলা অটোরিকশা-আটোটেম্পু-সিএনজি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান আমিন বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধে সরকারের সাথে আমরাও সহমত পোষণ করি। সেজন্য আমাদের শ্রমিকদের ডেকে মহাসড়কে না ওঠার নির্দেশনা দিয়েছি। তিন চাকার বাহনগুলোর মহাসড়ক ব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি পৃথক সড়ক নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

টাঙ্গাইল ট্রাফিক বিভাগের ইন্সপেক্টর মো. রফিকুল ইসলাম, গোড়াই হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম কাউছার ও হাইওয়ে পুলিশের এলেঙ্গা ফাঁড়ির এসআই রেজাউল একই সুরে জানান, মহাসড়কে কোন প্রকার থ্রি-হুইলার বা তিন চাকার ধীরগতির বাহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছেনা। ‘ভাত খেলে ভাত পড়ে’- এর মতো ২-১টা থ্রি-হুইলার সড়কে গিয়ে থাকতে পারে। তবে হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশ দিন-রাত মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছে, মহাসড়কে নির্বিঘœ যান চলাচল অব্যাহত রাখতে তারা বদ্ধপরিকর।

(আরকেপি/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮)